৩১ দফা নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে বিএনপি
- আপডেট সময় : ১১:৪৯:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৬৩ বার পড়া হয়েছে
গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ (একাংশ) এবং এএনডিএমের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি লিয়াজোঁ কমিটি
গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ (একাংশ) এবং এএনডিএমের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি লিয়াজোঁ কমিটি
সংবিধানের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের ৩১ দফা নিয়ে আবারও মানুষের কাছে যাবে বিএনপি ও দলটির সঙ্গে বিগত বছরে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। নতুন পরিবর্তিত রাজনীতিতে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তৈরি হওয়ায় সংস্কার-প্রশ্নে নিজেদের অবস্থানও তুলে ধরবে এই দলগুলো। ইতোমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোয় এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফাকে ইতোমধ্যে জনগণের কাছে তুলে ধরেছি। আমরা ৩১ দফাকে কর্মসূচি আকারে আবার মানুষের সামনে নিয়ে যাবো।’
সোমবার বিকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ (একাংশ) এবং এএনডিএমের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি লিয়াজোঁ কমিটি। আলাদাভাবে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন ভাবনা, প্রত্যাশা পূরণে যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিল তাদের নিয়ে করণীয় ঠিক করতে আমরা বসেছি। সকলের আস্থা আছে সরকারের ওপর। তাদের সার্বিক সহযোগিতা দেবো।’
আমির খসরু আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে কথা হয়েছে। ৩১ দফা সবাই মিলে ঠিক করেছি। বাস্তবায়নও একসঙ্গে করবো। জাতীয় সরকার বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করবো। মৌলিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের প্রত্যাশা করি। গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য মানুষ আন্দোলন করেছে। জনগণের কথায় চলবে দেশ।’
গত বছরের ১৩ জুলাই সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ ৩১ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। ৩১ দফা রূপরেখার উল্লেখযোগ্য দিক হলো— বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানো; ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন; সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; পর পর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না; সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে (দেখা হবে) বিবেচনা করা।
এছাড়া রয়েছে— স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল; ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন; ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন; ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন; সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ; দেড় দশকে গুম-খুনের বিচার; ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনও প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত না করা; মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন; যুক্তরাজ্যের আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন; সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালুর প্রতিশ্রুতি।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর “১৯ দফা”, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা’র “ভিশন ২০-৩০”; ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান “৩১ দফার আলোকে আগামীর বাংলাদেশকে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তোলাই বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলন শরিক দল এবং জোটের লক্ষ্য।
দলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটপরিবর্তনের পর চলতি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে এসেছে। রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উদ্যোগে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ গঠিত হয়েছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের বিশিষ্টজনেরাও রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রতিশ্রুতির মধ্যে আনা যায়।
বিএনপির বাইরে ৩১ দফা নিয়ে সোচ্চার অবস্থান রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চও। গত বছরের ১২ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চের ৩১ দফা ঘোষণা করা হয়। গণতন্ত্র মঞ্চের ৩১ দফা রূপরেখার উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— সংবিধানের এককেন্দ্রিক অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো এবং অগণতান্ত্রিক ও বিতর্কিত সাংবিধানিক যেসব সংশোধনী এনেছে, সেসব সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে রহিত/সংশোধন এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার, সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে জাতীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠা।
আরও রয়েছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য, পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে না পারা, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন, আস্থাভোট ও অর্থবিলের বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশনের আইন প্রণয়ন।
এছাড়া রয়েছে, পেপার-ব্যালট, বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্ন আদালতকে সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত করে উচ্চ আদালতের অধীনস্ত করা, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন, মিডিয়া কমিশন গঠন, সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ, গুম-খুনের বিচার নিশ্চিত, প্রবৃদ্ধির সুফল সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর ও তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, বিএনপির ৩১ দফা ও মঞ্চের ৩১ দফার মধ্যে মৌলিকভাবে বেশি পার্থক্য নেই। ২০২৩ সালের ১২ জুলাইয়ে একসঙ্গে ঘোষণার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পৃথকভাবে ঘোষণা করে (১৩ জুলাই) বিএনপি।
সোমবার গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি
সোমবার গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আল্টিমেটলি প্রশ্নটা রাজনৈতিক। সংস্কার বা রূপান্তর যাই বলি না কেন, রাজনৈতিক দলগুলো বিগত কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রের সংস্কারের কথা জোর দিয়ে বলে আসছে, কর্মসূচি দিয়েছে। এখন নতুন করে সংস্কারের বিষয়টি এসেছে। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কার এজেন্ডাকে সামনে আনছে।’
‘গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষে থেকে লাগাতারভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি! এই রূপান্তরের প্রধান পদক্ষেপ হলো- সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ও ইনক্লুসিভ করা। গণতন্ত্র মঞ্চ থেকেও বেশ ক’বছর ধরে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে’— উল্লেখ করেন গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য সৈকত মল্লিক।
সোমবার রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমরা খুব আশাবাদী যে, বর্তমান প্রজন্ম এই প্রশ্নটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সামনে নিয়ে এসেছে। তারা আমাদের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ তৈরির কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে! যা নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ভীষণ ইতিবাচক।’
সম্প্রতি ১২ দলীয় জোটের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিএনপির বৈঠকে ৩১ দফার বিশেষ দিকগুলোকে আলোচনায় রাখার প্রস্তাব এসেছে। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে জোটের নেতারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্যে তুলে ধরছেন।
এ বিষয়ে জোটের মুখপাত্র, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারেক রহমান ঘোষিত ২৭ দফার ভিত্তিতেই ৩১ দফা প্রণীত হয়েছে। আমরা এই ৩১ দফার বিভিন্ন বিশেষ প্রতিশ্রুতিগুলোকে সামনে তুলে ধরছি। বিশেষ করে রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধানকে গণতান্ত্রিক করার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সে বিষয়টি মুখ্য হিসেবে দেখছি।’
শাহাদাত হোসেন সেলিমের ভাষ্য, ‘৩১ দফার মধ্যে সংস্কারমূলক প্রতিশ্রুতিগুলোকে আমরা মানুষের সামনে তুলে ধরবো। দেশে সুশাসন স্থায়ী করতে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের কোনও বিকল্প নেই। প্রাথমিক সংস্কারের কাজশেষে অন্তবর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করতে হবে।’
বিএনপির একটি দায়িত্বশীলসূত্র জানায়, গত কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোতে যুগপতে যুক্ত দলগুলোকে ঐক্য ধরে রেখে ‘সাবধানে থাকার’ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে কোনও পক্ষের প্ররোচনায় পড়ে বক্তব্য না দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ৩১ দফার বিষয়টি আলোচনায় থাকবে। এক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্ত তুলে ধরবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতা জানান, আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের কথা রয়েছে।