তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখনো কোনো বিতর্কিত বক্তব্য না দেওয়ায় দলটি সরকারের ওপরে আস্থা রাখছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, বিএনপি জনগণকে ভোটের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখানে কেউ যদি ভিন্ন পথে চলতে চায়, তাহলে তাদেরও সঠিক পথটা বেছে নিতে হবে।
তিনি বলেন, গত ১৬ বছর দেশের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া জন্য, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট গঠন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে হবে। কেউ যদি অন্য পথে চলতে চায়, তাদের সঠিক পথ দেখানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। এখানে দূরত্ব তৈরি হওয়ার মতো কিছু হয়নি।
জানা গেছে, সরকার ও বিএনপির মধ্যে দূরত্বের মূল কারণ হলো নির্বাচনের সুস্পষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা না করা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র বিনির্মাণের ক্ষেত্রে ঠিক কতটা সংস্কার করা হবে, তা নিয়েও সরকারের সঙ্গে বিএনপির সন্দেহ-অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’ (ঘোষণাপত্র) তৈরি এবং সংবিধান বাতিলসংক্রান্ত বক্তব্য নিয়েও দ্বিমত স্পষ্ট হয়েছে। যদিও বিএনপির আপত্তির কারণে ওই ঘোষণাপত্র স্থগিত করা হয়েছে। সংবিধান বাতিলের বিষয়ে আপাতত কেউ বক্তব্য দিচ্ছে না।
তবে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এখনো অব্যাহত আছে। গত বুধবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, অভ্যুত্থানের মালিকানা হাইজ্যাক করার চেষ্টা করবেন না। গতকাল গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও লুটপাট। সরকার, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সৃষ্ট বিতর্কের সূত্র ধরে তিনি ওই মন্তব্য করেছেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
জানা গেছে, নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যু ছাড়াও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার না হওয়ার কারণেও সরকারকে সন্দেহ করছে বিএনপি। এ ছাড়া সংস্কার নাকি নির্বাচন কোনটি আগে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা, রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে দ্বিমত, ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৭ বছর করার উদ্যোগ নিয়েও বিএনপির আপত্তি রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে গত ১৬ বছরে বিএনপির আন্দোলনের অন্তর্ভুক্তি দাবি, জামায়াতের সঙ্গে সরকার ও বৈষম্যবিরোধীদের সখ্য বৃদ্ধি এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে শুরু হয়েছে স্পষ্টত বিভক্তি। এতে বিপ্লবের মূল চেতনা বেহাত হতে পারে। বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতেও শুরু হয়েছে নানামুখী তৎপরতা। এতে আবারও আওয়ামী লীগ ফিরে আসার পথ তৈরি হতে পারে। তাই ঐক্য ধরে রাখতে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ জরুরি বলেও তারা মত দেন।
যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কার, নির্বাচন ও ঐক্য- এই তিন বিষয়ে প্রাধান্য দিয়েই আগামীতে তাদের পথচলার কৌশল নির্ধারণ করতে চান। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার প্রতিবেশীদের সঙ্গেই সখ্য বাড়াতে তৎপর শীর্ষ নেতৃত্ব। এরই অংশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশসহ পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তবে এ বছরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর বিএনপি। তবে এখনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিরোধ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির।
তারা বলেন, উপদেষ্টাদের কিছু মন্তব্য এবং সরকার-সমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে বিএনপির আশঙ্কা দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে সরকারের মনোভাব বুঝে সিদ্ধান্ত বদলের কৌশলও রয়েছে তাদের। সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করার দাবি বিএনপির।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধিতা চলছে বিএনপি, জামায়াতসহ তাদের মিত্রদের। সংস্কার আগে, নাকি নির্বাচন আগে- এ নিয়েই মূলত দূরত্ব বাড়ছে। বিএনপিসহ মিত্র দল ও জোটগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরই নির্বাচন চাইছে। সংস্কার কবে নাগাদ শেষ হবে তার দিনক্ষণ জানতে চায় তারা। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে সরকারের যৌক্তিক সময় দিতে চায়। আবার ছাত্র নেতৃত্ব সার্বিক সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলছে। সবমিলিয়ে চলছে দোষারোপের খেলা।
সংস্কার প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সে জন্য তো নির্বাচন বন্ধ হয়ে থাকতে পারে না। দিনের পর দিন একটি অনির্বাচিত সরকারকে দেশ চালাতে দিতে পারি না।’
আর গত বুধবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেছেন, ‘আগে সংস্কার পরে নির্বাচন- এ কথার কোনো অর্থ নেই। নির্বাচনের অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে।’
অন্যদিকে বিএনপি যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে সে জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চক্রান্ত চলছে বলেও অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়েও সন্দিহান দলটির নেতারা। তাদের অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতাদের ওপর ভর করে একের পর এক ইস্যু সৃষ্টির পেছনে জামায়াতের হাত রয়েছে। প্রকাশ্যে এক কথা বললেও সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে গোপন খেলায় লিপ্ত রয়েছে জামায়াত। তারা নির্বাচন প্রশ্নেও দ্বৈত ভূমিকা রাখছে। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের তৈরির পেছনে তাদের ইন্ধন রয়েছে। ফলে এসব ইস্যুতেও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে, দুই দলের মধ্যেও চলছে রাজনৈতিক বাহাস। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন দুই দলের শীর্ষ নেতারা।
জামায়াতে ইসলামীকে উদ্দেশ করে গতকাল বৃহস্পতিবার সিলেটে এক কর্মসূচিতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘একাত্তরে আপনাদের রাজনৈতিক ভূমিকা কী ছিল? কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন? বাংলাদেশে কেউ দেশপ্রেমিক নেই, শুধু একটি রাজনৈতিক দল দেশপ্রেমিক- এই ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করলে মানুষ হাসবে।’
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছর নির্ধারণের মন্তব্য এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপের ঘোষণা না দেওয়ায় হতাশ ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। অনেকটা অভিযোগের সুরে মির্জা ফখরুল বলেছেন, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নির্বাচনকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে বলে জনমনে ধারণা তৈরি হচ্ছে।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত রবিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সাবেক দুই নেতা তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। ওই বৈঠকে বিএনপির স্পষ্ট অবস্থান ও মনোভাব তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন মির্জা ফখরুল। পরের দিন সোমবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপরই মূলত ছাত্ররা ঘোষণাপত্র স্থগিত করেন। বিএনপি মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে এই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হলে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান এটা বিপ্লব নয়, গণ-অভ্যুত্থান। ফলে প্রোক্লেমেশন (ঘোষণাপত্র) নয়, গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে একটা ডিক্লারেশন (ঘোষণা) আসতে পারে।
এই বিষয়ে সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, একাত্তরের শহিদদের রক্ত দিয়ে লেখা যে সংবিধান, সে সংবিধানকে যখন কবর দেওয়ার কথা বলা হয় তখন কিন্তু আমাদের কষ্ট লাগে। এটি কিন্তু ফ্যাসিবাদের মুখের কথা। ওই সংবিধানে যদি খারাপ কিছু থাকে নিশ্চয় সেটা বাতিলযোগ্য।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলা নিয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন বিএনপির নেতারা। তাদের দাবি, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা হলেও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের লাখ লাখ মামলা এক আদেশে কেন প্রত্যাহার হচ্ছে না। এখনো কেন আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে?