৬টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?
- আপডেট সময় : ১০:২৬:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪৪ বার পড়া হয়েছে
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণে দেশের জনসাধারণ বহু আগেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তথা রাজনৈতিক সরকারের কাছে প্রকৃত মঙ্গলজনক কিছু আশা করা ছেড়ে দিয়েছে বহু আগেই। তাই, দেশের মানুষ এমনসব ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চান যারা নিজেদের আখের গোছানো, অর্থবৃত্তের পাহাড় গড়া আর বিদেশের ব্যাংকে কাড়ি কাড়ি টাকা রাখার চিন্তা করবেনা। জনসাধারণের সেই ধরনের ব্যক্তিবর্গ দ্বারা বর্তমানে দেশ পরিচালিত হচ্ছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত, যারা সরাসরি জনগণকে সেবা প্রদান করবেন তারা তো অধিকাংশই সেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ধ্বাজাধারী, তাদেরই সৃষ্ট এবং দেশের সব প্রতিষ্ঠান দুর্বৃত্তায়ন আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে রূপান্তর করে রেখেছেন।
এদের নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে বর্তমানকালের জনগণের বহুল প্রতিক্ষীত সরকারকে। তারপরও জনগণ আশায় বুক বেঁধে আছেন। তারা অন্তবর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা ও বাঁধার পাহাড় সম্পর্কে তারা জানেন তারপরেও একটু বেশি বেশি আশা করে আছেন। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করতে হবে, ঢেলে সাজাতে হবে যা চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক বন্ধুর, অনেক চ্যালেঞ্জিং এই পথ! তারপরেও মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বর্তমান সরকার সেসব সংস্কারে হাত দিয়েছে।
আমরা দেখলাম যে, সরকার ইতোমধ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এসব কমিশন পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এই কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাসী এই অন্তবর্তীকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে এখানকার সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়েছে যা প্রশংসার দাবিদার। নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য আপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানা ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ চৌধুরি, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে জনাব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।
আমরা মনেপ্রাণে এবং পূর্ণাঙ্গভাবে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি এবং যে-সব ব্যক্তিত্বকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাঁরা সবাই জনসাধারণের কাছে নন্দিত। কিন্তু আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি আমাদের একটি আশা ছিল যে, প্রাথমিকভাবে বর্তমান সরকার শিক্ষা কমিশনও গঠন করবে। সেটি না দেখে আমরা কিছুটা হতাশ হয়েছি। আমরা তারপরেও বিশ্বাস করি আমাদের জাতির গর্ব এবং বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব জনাব ড. মুহম্মদ ইউনূস স্যার নিশ্চয়ই শিক্ষার জন্য এমন কিছু করবেন যা আমরা হয়ত চিন্তাও করিনি। শিক্ষা তার কাছে অগ্রাধিকার পাবে, এটি আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চ প্রশাসনিক পদগুলো পূরণ করে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ডে দখলদারিত্বের রাজনীতি বন্ধ করার ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। অতীতে শুধু আওয়ামী মতাদর্শী না হওয়ার কারণে ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বিপিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত অনেক প্রার্থী নিয়োগ বঞ্চিত ছিলেন, ৮ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ২৫৯জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। বই সংশোধন এবং পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। এ সংস্কারের কাজ অব্যাহত থাকবে। বর্তমান সরকারের প্রথম মাসে দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য মহোদয়গণ পদত্যাগ করেছেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। ক্রমাগতভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এর ফলে সকল সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ যেন উজ্জ্বল হয় সেটি নিশ্চিত করতে শিক্ষাব্যবস্থার দিকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের পূর্ন নজর রয়েছে বলে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ইতিমধ্যে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সংস্কার চাই। আমাদের একান্ত অনুরোধ আমাদের ওপর যে সংস্কারের গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব দিয়ে আপনারা দর্শকের গ্যালারিতে চলে যাবেন না। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমরা একসঙ্গে সংস্কার করবো। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। আপনারা নিজ নিজ জগতে সংস্কার আনুন। একটা জাতির সংস্কার শুধু সরকারের সংস্কার বলে হয় না। আপনি যেখানে আছেন সেখানে সংস্কার নিয়ে আসুন।’ চমৎকার কথা বলেছেন। অনেকের শুধু অন্যের ওপর নির্ভর করে নিজের দায়িত্ব এড়াতে চান। সবকিছু যেন এমনিতেই হয়ে যাবে, সবই যেন সরকারকে করতে হবে এবং এই সরকারকে, এটি ভুল ধারণা। সবাই মিলে একই লক্ষ্যে আমরা অগ্রসর হতে চাই।
আমাদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে আছে সেটা যেন বিনা বাধায় রাষ্ট্রের এবং সমাজের সহযোগিতায় প্রকাশ করা যায় সেই সুযোগের কাঠামো তৈরি করার প্রচেষ্টা সরকার চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র, শ্রমিক, জনতার এই বিপ্লবের লক্ষ্যকে আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং জনগণকে মন খুলে সরকারের সমালোচনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। অথচ তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো জনগণের কোন সমালোচনাই শুনতে রাজী ছিলনা। বর্তমান সরকার ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করার কথাও চিন্তা করছে। আরো যে-সব কমিশন সরকারসহ অন্য সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়, সেগুলোর পুনর্গঠন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে বর্তমান সরকার জানিয়েছে।
যে ছয়টি কমিশন ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করতে পারবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন। পরবর্তী তিনমাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করছেন তিনি। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শসভার আয়োজন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেয়া হবে। আরো বিভিন্ন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার কথাও প্রধান উপদেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেন।
আমরা আশা করছি ‘শিক্ষা কমিশনের’ কথা শিগগিরই ঘোষণা করা হবে কারণ শিক্ষার সংস্কারের সাথে দেশের প্রতিটি বিভাগের উন্নয়ন, সততা ও প্রকৃত পেশাদারিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পূর্ববর্তী সরকারগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই ‘লিপ সার্ভিস’ দিয়ে রাষ্ট্রের বাকী বিভাগগুলোতে অবৈধ সুযোগ সুবিধার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। ফলে, জনগণের কোন উপকার হয়নি, সরকারগুলো নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছে আর শিক্ষাকে সব সময়ই অবজ্ঞা করেছে। কাজেই জনগণের পাহাড়সম আশা বর্তমানসরকার শিক্ষাকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাবে যেটি হবে বিশ্বমানের আর সেটি করার জন্য ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠন একটি অপরিহার্য শর্ত।
মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক; সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ