গণপরিবহনে নারী হয়রানি: সমাধান কোথায়

- আপডেট সময় : ০৬:২৮:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 93
যাত্রাপথে গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির অভিযোগ নিত্যদিনের। বছরের পর বছর চলে আসছে এই সংস্কৃতি। বাংলাদেশে বিশেষ করে নারীরা বাস ও ট্রেনের মতো গণপরিবহনে ভ্রমণকালে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক হয়রানির সম্মুখীন হন, যার মধ্যে শ্লীলতাহানি, অশালীন মন্তব্য এবং শারীরিক আক্রমণ অন্যতম। এই সমস্যা শুধু নারী সুরক্ষা নয়, সমগ্র সমাজের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু পরিবহনব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির পেছনে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষার অভাব। পরিবহন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো ও মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থান যথাযথভাবে নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা নারী হয়রানির অন্যতম কারণ। বাস, ট্রেনে যাতায়াতের সময় সীমিত আসনের তুলনায় অধিক যাত্রী বহন এবং দাঁড়িয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা না থাকায় নারীদের নিরাপত্তা সংকটকে বাড়িয়ে তোলে।
গণপরিবহনে রয়েছে নারীদের জন্য আলাদা আসনের ঘাটতি। পাশাপাশি অনেক পরিবহন রয়েছে যেখানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন পুরোপুরি অনুপস্থিত। ফলে দুষ্ট লোকেরা পরিবহন খাতের এইসব দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের স্পর্শ করার চেষ্টা করে। এছাড়াও লিঙ্গবৈষম্য ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে আমাদের সমাজে নারীদের প্রায়ই দুর্বল ও অধীনস্থ হিসেবে দেখা হয়।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির জরিপ অনুযায়ী, মোট ৩৬ শতাংশ কর্মজীবী নারীর ৮০ ভাগই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন এবং তারা অধিকাংশ সময়ে হয়রানির মুখোমুখি হন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী একটি বাসে হয়রানি শিকার হওয়া কর্মজীবী এক নারীর কথা। যেখানে বাসের হেলপার তার শরীরে অশালীনভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে তিনি প্রতিবাদ করেন। তবে সেখানে আশপাশের যাত্রীরা কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নারীদের ব্যক্তিগত মর্যাদাকে অসম্মান, উপেক্ষা করা বর্তমানে অনেকের কাছে তুচ্ছ বিষয়। লিঙ্গবৈষম্যের এই মনোভাব নারীদের সম্মানহানির একটি বড় কারণ।
এছাড়াও নারীদের এসব হয়রানির জন্য দায়ী আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। যৌন হয়রানিসংক্রান্ত আইন থাকলেও এর প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর। যার ফলে অপরাধীরা প্রায়ই শাস্তি থেকে রেহাই পায়, যা তাদের একই অপরাধে জড়াতে বারবার উৎসাহিত করে। একটি গবেষণায় (ঢাকা শহরের পরিবহন নিয়ে) দেখা গেছে, ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি পুরুষের দ্বারা এসব হয়রানি বেশি ঘটে। জাতিসংঘের নারী বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি মেয়েরা সবচেয়ে বেশি তাদের লক্ষ্যবস্তু হয়।
পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। রাতের বেলা নিরাপত্তাহীন পরিবেশ নারীদের জন্য আরো ঝুঁকিপূর্ণ। নারীদের গণপরিবহনে নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং হয়রানি এড়াতে আইন প্রয়োগে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ২০১০ সালে প্রণীত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ এবং ২০১৯ সালের ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ ঠিকভাবে প্রয়োগ করা উচিত।
একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত, যেখানে নারীদের হয়রানিসংক্রান্ত মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হবে। গণপরিবহনগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কেবল তাদের অধিকারই নয়, এটি একটি নিরাপদ এবং সম্মানজনক সমাজ গড়ারও পূর্বশর্ত।
নারীদের সম্মানিত করার মাধ্যমে আমরা একটি উন্নত ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ