পূর্বে নেপাল, পশ্চিমে বাংলাদেশ। মাঝখানে একটি খুব সরু অংশ ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে। এটি এতই সরু যে ম্যাপে একটু কল্পনা করলেই মনে হয় চিকেন নেক বা মুরগির গলা। এলাকাটি উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দেশের বাকি অংশের মধ্যে একটি সংযোগ হিসাবে অবস্থিত। শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া, নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া এবং চোপড়া ও ইসলামপুরের কিছু অংশ এই চিকেন নেক বা মুরগির গলায় পড়ে। এই অংশটিকে শিলিগুড়ি করিডোরও বলা হয়। কারণ উত্তর-পূর্ব ভারত ও দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগের একমাত্র ভরসা সেই সরু জমি খানি । অনেকটা করিডোরের মতো। এটি শিলিগুড়ির ছোঁয়ায় অবস্থিত, তাই এটিকে শিলিগুড়ি করিডোরও বলে ।
শিলিগুড়ি করিডোর কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর শিলিগুড়ি। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে দেশের অন্য কোনো অংশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে শিলিগুড়ি একটি জংশনের মতো। ফলস্বরূপ, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের কাছে শিলিগুড়ির অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। শিলিগুড়ি করিডোরের আন্তর্জাতিক গুরুত্বও যথেষ্ট। নেপাল এবং ভুটানও বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য শিলিগুড়ি করিডোরের উপর অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় ।
অর্থাৎ, শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক দেশের দুটি অংশের মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য, উত্তর-পূর্ব এবং বাকি ভারতের মধ্যে একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসাবে কাজ করার জন্য এবং নেপাল ও ভুটানের সাথে ভারতের দৈনন্দিন যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
অক্ষত চিকেন নেক হারালে কি হতে পারে?
এই অঞ্চল ভারতের কাছ থেকে হারিয়ে গেলে উত্তর-পূর্ব ভারত আলাদা হয়ে যাবে। উত্তরবঙ্গের তিন জেলায়ও তাই হবে। চীনের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন করা খুব সহজ যদি তারা উত্তর-পূর্ব ভারতকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, যেটি উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে চীনের সাথে অনেক উত্তেজনা রয়েছে এবং চিকেনস নেকের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।
ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর ‘চিনেক নেক’ বা ‘চিকেনের নেক’ নামে পরিচিত। এই করিডোরটিকে দ্বি-ধারী তলোয়ার, অ্যাকিলিস হিল বা হিলও বলা হয়। শিলিগুড়ি করিডোরকে এর ভৌগোলিক গুরুত্ব এবং ভারতের প্রজাতন্ত্রের যোগাযোগ, নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক বিবেচনার কারণেও একে চিকেনের নেক বলা হয়।
ভৌগলিকভাবে শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত। এই করিডোরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এর প্রস্থ প্রায় ২০ কিমি। এই করিডোরের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারত মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত। এই করিডোর না থাকলে উত্তর-পূর্ব ভারত মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কারণ উত্তর-পূর্ব ভারত সম্পূর্ণরূপে স্থলবেষ্টিত। এর আশেপাশে কোথাও সমুদ্র নেই।
ভারতে মোট ২৮ টি রাজ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি প্রদেশ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। এগুলো হলো সিকিম, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, অরুণাচল এবং নাগাল্যান্ড। সিকিম বাদে বাকি সাতটি প্রদেশ সম্মিলিতভাবে সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত। ভৌগোলিকভাবে সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড বা রাজধানী থেকে অনেক দূরে। নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অঞ্চলগুলির সাথে মিয়ানমারের অনেক মিল রয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে চীন অরুণাচল প্রদেশের একটি বড় অংশকে ‘দক্ষিণ তিব্বত’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা ওই অংশটিকে চীনের বলেও দাবি করে। সামগ্রিকভাবে, শিলিগুড়ি করিডোরকে অ্যাকিলিসের হিল হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। গ্রীক মহাকাব্যের নায়ক অ্যাকিলিসের শরীরে প্রায় কোনো অস্ত্রের আঘাত লাগতোনা। কিন্তু তার গোড়ালি ছিল ব্যতিক্রম। কিংবদন্তি অনুসারে, ট্রোজান যুদ্ধের সময় ট্রোজান রাজপুত্র প্যারিসের একটি তীর অ্যাকিলিসের গোড়ালিতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে মহাবীর নিহত হন। আপাতদৃষ্টিতে শক্তিশালী ব্যক্তির তুলনামূলক দুর্বল অংশকে অ্যাকিলিসের হিল বলা হয়।
শিলিগুড়ি করিডোর হল ১৯৪৭ সালের পর ভারতের জাতীয় ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এই করিডোরটি মূলত অরক্ষিত ছিল। ১৯৭৫ সালে, স্বাধীন সিকিম ভারতে যোগ দেয় এবং একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এতে শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা বাড়ে।
শিলিগুড়ি করিডোরের মধ্য দিয়ে যে রেলপথ যায় তার একটি মাত্র লাইন রয়েছে। এই করিডোর প্রায়ই ভূমিধস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা প্রভাবিত হয়। চীন এই করিডোর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কোনো কারণে শিলিগুড়ি করিডোর দখল করা হলে, মূল ভূখণ্ড ভারত উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ও নেপাল-ভুটানের মধ্যে ভারতীয় ভূখণ্ডের ভৌগোলিক আকৃতি অনুযায়ী ‘চিকেন নেক’ বা মুরগির ঘাড় রয়েছে। সেই ফুলবাড়ি-শিলিগুড়ি করিডোরের দূরত্ব মাত্র ২২ কিমি। বিভিন্ন স্থানে প্রস্থ ২১ থেকে ৪০ কিমি। পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের সীমান্তে ভারতীয় জমির একটি সরু স্ট্রিপ, যা চিকেন নেক নামেও পরিচিত। একদিকে বাংলাদেশ অন্যদিকে ভুটান ও নেপাল। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ-ভারত ফুলবাড়ী চুক্তি সম্পাদিত হয়। ফলে ভারতের এই ছোট করিডোর রুট দিয়ে বাংলাদেশ-নেপাল পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার রয়েছে। কিন্তু ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই চুক্তির কথা কাজীর গুরু কিতাবে আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই।