ঢাকা ০১:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫, ২১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মঈনুদ্দিনের পরিচয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের পরিচয় শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে সব প্রমাণ সরকারের কাছে আছে জেলায় জেলায় সরকারি অর্থে ‘আওয়ামী পল্লি’ উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হচ্ছেন সি আর আবরার উপদেষ্টা হচ্ছেন ড. আমিনুল ইসলাম পদত্যাগ করলেন নাহিদ ইসলাম বাবরের জীবন থেকে ১৭ বছর কেড়ে নেয় ‘প্রথম আলো’ সোমবার থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চাপমুক্ত প্রশাসন এবং ড. ইউনূসের দর্শন ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ পালনের ঘোষণা আনিসুল হকের মুক্তি চেয়ে পোস্টার দিল্লিতে গৃহবন্দী শেখ হাসিনা? গ্যাস-বিদ্যুতে ভয়াবহ ভোগান্তির আশঙ্কা ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন প্রধান উপদেষ্টা হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ মোদি-হাসিনা মাইনাস: ট্রাম্পের আস্থায় এখন ড. ইউনূস! মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ডের বাংলাদেশ নিয়ে ভাইরাল ভিডিওর আসল ঘটনা আমি ফিরব, আমাদের শহিদদের প্রতিশোধ নেব’: শেখ হাসিনা অপরাধী হাসিনাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপে ভারত

জাতীয় নাগরিক পার্টির সংকট ও সম্ভাবনা

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০২:৪৬:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫
  • / 28
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে নতুন দল হিসেবে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ আত্মপ্রকাশ করেছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে একটি নতুন রাজনীতিক দল গড়ে উঠবে– এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে গত ছয় মাস ধরেই চলছিল। আত্মপ্রকাশের আগেই ‘কিংস পার্টি’র তকমা, আদর্শিক অবস্থান এবং নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি ইস্যুতে দলটি টক অব দ্য টাউন হিসেবে রাজনীতিতে তুমুল সাড়া ফেলেছে। নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক এবং আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করে জাতীয় নাগরিক পার্টির কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী দিনের রাজনীতিতে তরুণদের নতুন এই রাজনৈতিক দলের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়েই লেখাটির অবতারণা।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই কোনো না কোনো ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপকে নিউক্লিয়াস হিসেবে আত্মস্থ করে গড়ে উঠেছে। নিউক্লিয়াস থাকার সুবিধা হলো, পার্টিতে ভাঙন সৃষ্টি করা কঠিন (উদাহরণ– আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কংগ্রেস ইত্যাদি)। আবার তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা হলো, পরিবারতন্ত্র, গ্রুপিং, কোটারি ইত্যাদি। জাতীয় নাগরিক পার্টিতে সময়ের সঙ্গে ক্যারিশম্যাটিক কোনো লিডারশিপ সৃষ্টি না হলে পার্টিতে ভাঙনের আশঙ্কা থেকেই যাবে। সেই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের তরুণকে একই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে থেকে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি সেন্টার রাইট পলিসি ফলো করে তাহলে বিএনপির জন্য মাথাব্যথার কারণ হবে।

 

আবার জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি সেন্টার লেফট পলিসি ফলো করে তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাবে। কিন্তু এই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের তাত্ত্বিক আলোচনায় যতটুকু বোঝা যায়, জাতীয় নাগরিক পার্টি সেন্টার লেফট পলিসি গ্রহণ করবে। কিন্তু সেন্টার লেফট শহুরে নাগরিকরা তাদের সেন্টার লেফট হিসেবে বিশ্বাস করবে কিনা, এটা জাতীয় নাগরিক পার্টির আগামী দিনের রাজনীতিতে একটি বড় জিজ্ঞাসা হিসেবে হাজির হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হলে দুটি বড় আদর্শিক প্রশ্নকে মোকাবিলা করতে হবে। একটি হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ’; অন্যটি হলো ‘ধর্মীয় বিশ্বাস’। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিবদমান পক্ষগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রশ্নে নিজেদের সুবিধামতো বয়ান হাজির করে সমাজে বিভাজনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই দুটি আদর্শিক প্রশ্নে তরুণ নেতৃত্বের কথা শুনে মনে হয়েছে, এ বিষয়ে তাদের হোমওয়ার্ক বেশ ভালো। শুধু ভোটের রাজনীতি নয়, সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে যেসব আইডিওলজি সমাজে বিভাজনের নির্ণায়ক হিসেবে জারি আছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি সেসব আদর্শকে কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করে একটি বহুত্ববাদী রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল হলে জনগণ আশাবাদী হবে।

ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল, যেমন– বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মাঠের রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল নেতাদের ৯৫ শতাংশ সময়, শ্রম, অর্থ ও মেধা ব্যয় হয় অভ্যন্তরীণ দলীয় রাজনীতি (ইন হাউস পার্টি পলিটিকস) সামাল দিতে। গত ১৫ বছরে বিএনপির স্ট্রাগলের অন্যতম কারণ ছিল পার্টির অভ্যন্তরীণ ইন-হাউস পলিটিকস। একজন মাঠের নেতা ৫ শতাংশ সময় ব্যয় করে বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলা করার জন্য। বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলার স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করে টপ লেভেলের চার-পাঁচজন লিডার, যাদের পার্টিতে নিরঙ্কুশ অবস্থান আছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো বলা চলে। কিন্তু ‘অভ্যন্তরীণ দলীয় রাজনীতি’ দলটির নেতারা কীভাবে মোকাবিলা করবে, এর ওপর তাদের আগামী দিনের রাজনীতি নির্ভর করবে।

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মানি ম্যাটার’ করে। ক্রাউড ফান্ডিং এখানে কতটা সম্ভব? যখনই ব্যবসায়ীদের দ্বারা ফান্ডিং হবে তখনই অলিগার্ক সৃষ্টি হবে। এই অলিগার্ক শ্রেণির প্রধান চাহিদা ‘এক্সট্রা কেয়ার, এক্সট্রা ফ্যাসিলিটি এবং এক্সট্রা পাওয়ার’। যার অন্তিম পরিণতি লাগামহীন দুর্নীতি, নৈরাজ্যকর সিন্ডিকেট ও সীমাহীন লুটপাট। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এই জায়গায় ধরা খায়। দলীয় ফান্ডিং ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন কোনো স্ট্র্যাটেজি গত ৫৪ বছরে ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক দলগুলো হাজির করতে পারেনি। জাতীয় নাগরিক পার্টির ফান্ডিং ম্যানেজমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে আগামী দিনের রাজনীতিতে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির কমিটিতে অভিভাবকসুলভ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী, যেমন সামরিক-বেসামরিক আমলা, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা অধ্যাপক প্রভৃতি শ্রেণি সেভাবে নেই। এটা একদিক দিয়ে ভালো যে রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব জোরালোভাবেই অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু রাজনীতির স্বার্থে নাগরিক সমাজে যে হেজিমনি দরকার হবে, সেটা এই বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী শ্রেণিকে বাইরে রেখে প্রতিষ্ঠা করা জাতীয় নাগরিক পার্টির জন্য হয়তো দুরূহ হবে। এখানে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির করেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বারংবার ‘ইনক্লুসিভ রাজনীতি’র কথা বলছেন। আপনি মানেন কিংবা না-ই মানেন, বাংলাদেশের রাজনীতির ইনক্লুসিভ চেহারা অনেকটা এই মুরুব্বি শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের অতীত ভাবমূর্তি দ্বারাই প্রভাবিত হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুস্পষ্ট দুটি প্যাটার্ন আছে– একটা তৃণমূলের গ্রামীণ রাজনীতি (রুরাল পলিটিকস); অন্যটা শহুরে নাগরিকদের (আরবান) রাজনীতি। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাষ্যমতে, জাতীয় নাগরিক পার্টি আরবান পলিটিকস নিয়ে বেশ আশাবাদী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, রুরাল পলিটিকসের যে সামন্তবাদী ধারা, সেটা বড় ধরনের ধাক্কা খায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। তা ছাড়া রুরাল পলিটিকস স্রোতহীন নদীর মতো বড় কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই গত ৫০ বছর বয়ে চলেছে। গ্রাম্য রাজনীতিতে ‘বড় চৌধুরীর ছেলে ছোট চৌধুরী কিংবা মণ্ডলের পুত মণ্ডল’– এই যে প্যাটার্ন, জাতীয় নাগরিক পার্টি এই গ্রামীণ রাজনীতির সিলসিলাকে কতটুকু চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে– তার ওপর জাতীয় নাগরিক পার্টির রাজনীতি তৃণমূল পর্যায়ে জায়গা করে নিতে পারবে কিনা, সেটি নির্ভর করবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির ভারতপন্থি ও পাকিস্তানপন্থি রাজনীতিকে সোচ্চারভাবে প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ স্লোগান এই দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল মানুষের বহুত্ববাদী ধারণা ও মানবিক মর্যাদা বোধ প্রতিষ্ঠার নিরন্তর সংগ্রাম জারি রাখুক; এই আশাবাদ রেখে লেখাটির ইতি টানছি।

ফেরদৌস আনাম জীবন: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

জাতীয় নাগরিক পার্টির সংকট ও সম্ভাবনা

আপডেট সময় : ০২:৪৬:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫

 

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে নতুন দল হিসেবে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ আত্মপ্রকাশ করেছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে একটি নতুন রাজনীতিক দল গড়ে উঠবে– এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে গত ছয় মাস ধরেই চলছিল। আত্মপ্রকাশের আগেই ‘কিংস পার্টি’র তকমা, আদর্শিক অবস্থান এবং নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদি ইস্যুতে দলটি টক অব দ্য টাউন হিসেবে রাজনীতিতে তুমুল সাড়া ফেলেছে। নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক এবং আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করে জাতীয় নাগরিক পার্টির কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী দিনের রাজনীতিতে তরুণদের নতুন এই রাজনৈতিক দলের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়েই লেখাটির অবতারণা।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই কোনো না কোনো ক্যারিশম্যাটিক লিডারশিপকে নিউক্লিয়াস হিসেবে আত্মস্থ করে গড়ে উঠেছে। নিউক্লিয়াস থাকার সুবিধা হলো, পার্টিতে ভাঙন সৃষ্টি করা কঠিন (উদাহরণ– আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কংগ্রেস ইত্যাদি)। আবার তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা হলো, পরিবারতন্ত্র, গ্রুপিং, কোটারি ইত্যাদি। জাতীয় নাগরিক পার্টিতে সময়ের সঙ্গে ক্যারিশম্যাটিক কোনো লিডারশিপ সৃষ্টি না হলে পার্টিতে ভাঙনের আশঙ্কা থেকেই যাবে। সেই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের তরুণকে একই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে থেকে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি সেন্টার রাইট পলিসি ফলো করে তাহলে বিএনপির জন্য মাথাব্যথার কারণ হবে।

 

আবার জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি সেন্টার লেফট পলিসি ফলো করে তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকে ভাগ বসাবে। কিন্তু এই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের তাত্ত্বিক আলোচনায় যতটুকু বোঝা যায়, জাতীয় নাগরিক পার্টি সেন্টার লেফট পলিসি গ্রহণ করবে। কিন্তু সেন্টার লেফট শহুরে নাগরিকরা তাদের সেন্টার লেফট হিসেবে বিশ্বাস করবে কিনা, এটা জাতীয় নাগরিক পার্টির আগামী দিনের রাজনীতিতে একটি বড় জিজ্ঞাসা হিসেবে হাজির হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হলে দুটি বড় আদর্শিক প্রশ্নকে মোকাবিলা করতে হবে। একটি হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ’; অন্যটি হলো ‘ধর্মীয় বিশ্বাস’। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিবদমান পক্ষগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রশ্নে নিজেদের সুবিধামতো বয়ান হাজির করে সমাজে বিভাজনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই দুটি আদর্শিক প্রশ্নে তরুণ নেতৃত্বের কথা শুনে মনে হয়েছে, এ বিষয়ে তাদের হোমওয়ার্ক বেশ ভালো। শুধু ভোটের রাজনীতি নয়, সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে যেসব আইডিওলজি সমাজে বিভাজনের নির্ণায়ক হিসেবে জারি আছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি সেসব আদর্শকে কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করে একটি বহুত্ববাদী রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল হলে জনগণ আশাবাদী হবে।

ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল, যেমন– বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মাঠের রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল নেতাদের ৯৫ শতাংশ সময়, শ্রম, অর্থ ও মেধা ব্যয় হয় অভ্যন্তরীণ দলীয় রাজনীতি (ইন হাউস পার্টি পলিটিকস) সামাল দিতে। গত ১৫ বছরে বিএনপির স্ট্রাগলের অন্যতম কারণ ছিল পার্টির অভ্যন্তরীণ ইন-হাউস পলিটিকস। একজন মাঠের নেতা ৫ শতাংশ সময় ব্যয় করে বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলা করার জন্য। বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলার স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করে টপ লেভেলের চার-পাঁচজন লিডার, যাদের পার্টিতে নিরঙ্কুশ অবস্থান আছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো বলা চলে। কিন্তু ‘অভ্যন্তরীণ দলীয় রাজনীতি’ দলটির নেতারা কীভাবে মোকাবিলা করবে, এর ওপর তাদের আগামী দিনের রাজনীতি নির্ভর করবে।

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মানি ম্যাটার’ করে। ক্রাউড ফান্ডিং এখানে কতটা সম্ভব? যখনই ব্যবসায়ীদের দ্বারা ফান্ডিং হবে তখনই অলিগার্ক সৃষ্টি হবে। এই অলিগার্ক শ্রেণির প্রধান চাহিদা ‘এক্সট্রা কেয়ার, এক্সট্রা ফ্যাসিলিটি এবং এক্সট্রা পাওয়ার’। যার অন্তিম পরিণতি লাগামহীন দুর্নীতি, নৈরাজ্যকর সিন্ডিকেট ও সীমাহীন লুটপাট। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এই জায়গায় ধরা খায়। দলীয় ফান্ডিং ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন কোনো স্ট্র্যাটেজি গত ৫৪ বছরে ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক দলগুলো হাজির করতে পারেনি। জাতীয় নাগরিক পার্টির ফান্ডিং ম্যানেজমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে আগামী দিনের রাজনীতিতে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির কমিটিতে অভিভাবকসুলভ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী, যেমন সামরিক-বেসামরিক আমলা, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা অধ্যাপক প্রভৃতি শ্রেণি সেভাবে নেই। এটা একদিক দিয়ে ভালো যে রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব জোরালোভাবেই অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু রাজনীতির স্বার্থে নাগরিক সমাজে যে হেজিমনি দরকার হবে, সেটা এই বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী শ্রেণিকে বাইরে রেখে প্রতিষ্ঠা করা জাতীয় নাগরিক পার্টির জন্য হয়তো দুরূহ হবে। এখানে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির করেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি বারংবার ‘ইনক্লুসিভ রাজনীতি’র কথা বলছেন। আপনি মানেন কিংবা না-ই মানেন, বাংলাদেশের রাজনীতির ইনক্লুসিভ চেহারা অনেকটা এই মুরুব্বি শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের অতীত ভাবমূর্তি দ্বারাই প্রভাবিত হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুস্পষ্ট দুটি প্যাটার্ন আছে– একটা তৃণমূলের গ্রামীণ রাজনীতি (রুরাল পলিটিকস); অন্যটা শহুরে নাগরিকদের (আরবান) রাজনীতি। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাষ্যমতে, জাতীয় নাগরিক পার্টি আরবান পলিটিকস নিয়ে বেশ আশাবাদী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, রুরাল পলিটিকসের যে সামন্তবাদী ধারা, সেটা বড় ধরনের ধাক্কা খায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। তা ছাড়া রুরাল পলিটিকস স্রোতহীন নদীর মতো বড় কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই গত ৫০ বছর বয়ে চলেছে। গ্রাম্য রাজনীতিতে ‘বড় চৌধুরীর ছেলে ছোট চৌধুরী কিংবা মণ্ডলের পুত মণ্ডল’– এই যে প্যাটার্ন, জাতীয় নাগরিক পার্টি এই গ্রামীণ রাজনীতির সিলসিলাকে কতটুকু চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে– তার ওপর জাতীয় নাগরিক পার্টির রাজনীতি তৃণমূল পর্যায়ে জায়গা করে নিতে পারবে কিনা, সেটি নির্ভর করবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির ভারতপন্থি ও পাকিস্তানপন্থি রাজনীতিকে সোচ্চারভাবে প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ স্লোগান এই দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল মানুষের বহুত্ববাদী ধারণা ও মানবিক মর্যাদা বোধ প্রতিষ্ঠার নিরন্তর সংগ্রাম জারি রাখুক; এই আশাবাদ রেখে লেখাটির ইতি টানছি।

ফেরদৌস আনাম জীবন: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি)