জেনেরিক ঔষধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস!

- আপডেট সময় : ০৭:০৭:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪
- / 121
জেনেরিক ড্রাগ উৎপাদনের পথটি অনেক পরিবর্তন এবং উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে গেছে, যা আজকের এই বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
আমেরিকায় ১৮৮৮ সালের দিকে প্রথম জেনেরিক ওষুধের কারখানা তৈরির পর থেকেই ওষুধের গুণমান নিয়ে বিতর্ক তৈরী হয়। গুণমান রক্ষার জন্য আমেরিকার কংগ্রেসে ১৯০৬ সালে ‘ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাক্ট” চালু হয়। এরপরে ১৯২৮ এবং ১৯৩৮ সালে আরও পরিবর্তন/সংশোধনী আসে।
ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাক্ট (Federal Food and Drugs Act) যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০৬ সালে চালু হয়। এই আইনটি প্রাথমিকভাবে খাদ্য এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল। আইনটি প্রণয়ন করা হয় খাদ্য এবং ওষুধের ভেজাল ও ভুলভাবে লেবেলিং প্রতিরোধ করার জন্য। এটি ছিল প্রথম ফেডারেল আইন যা খাদ্য ও ওষুধের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মান নির্ধারণ করেছিল।
এই আইনটি পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে ফেডারেল ফুড, ড্রাগ, এবং কসমেটিক অ্যাক্ট (Federal Food, Drug, and Cosmetic Act) দ্বারা প্রতিস্থাপন হয়, যা খাদ্য, ওষুধ, এবং প্রসাধন সামগ্রীর নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য আরও কঠোর নিয়মাবলী তৈরী করে।
১৯৩৭ সালে Elixir Sulphanilamide-এর (জেনেরিক ওষুধ ছিল) ব্যবহারের ফলে ১০৭ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ফার্মাসিউটিক্যাল নিয়ন্ত্রণের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় বলে বিবেচনা করা হয়। এই ওষুধটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক ছিল, কিন্তু এর সলভেন্ট বা দ্রাবক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ডায়েথিলিন গ্লাইকোল (Diethylene Glycol), যা একটি বিষাক্ত রাসায়নিক।
এই ঘটনাটি ফেডারেল ফুড, ড্রাগ, এবং কসমেটিক অ্যাক্ট (Federal Food, Drug, and Cosmetic Act) ১৯৩৮ সালে প্রণয়নের পথ প্রশস্ত করে। নতুন এই আইনটি ওষুধের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য আরও কঠোর নিয়মাবলী প্রবর্তন করে। এর ফলে ওষুধ বাজারজাত করার আগে তাদের পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া এবং প্রমাণপত্রের মাধ্যমে নিরাপত্তা যাচাই করা বাধ্যতামূলক হয়।
এরও অল্পদিন পরে বিশ্বের মান্য এবং অনেকাংশে নির্ভরযোগ্য স্ব-শাসিত সংস্থা “ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA)” তৈরি হয়। FDA থেকে একটি ওষুধের বাজারে আসার জন্য লাইসেন্স পেতে অত্যন্ত কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পাস করতে হয়
আমেরিকার প্রেক্ষাপটে আগে থেকেও সীমিত পরিসরে শুরু হলেও বিস্তৃত পরিসরে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন ১৯৬০-এর দশকে শুরু হয়। সে সময়ে, ব্র্যান্ডেড ওষুধের পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অন্যান্য কোম্পানিগুলি ওই ওষুধগুলির জেনেরিক সংস্করণ উৎপাদন শুরু করে।
১৯৮৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে হ্যাচ-ওয়াক্সম্যান অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর, জেনেরিক ওষুধের বাজার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই আইনটি পেটেন্ট সুরক্ষার সময়সীমা নির্ধারণ করে এবং জেনেরিক ওষুধের জন্য ফাস্ট-ট্র্যাক অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রবর্তন করে।
পরবর্তীতে অন্য অনেক দেশ, যেমন ব্রাজিল, চীন, এবং দক্ষিণ কোরিয়া, বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনের খাতে প্রবেশ করে। এই দেশগুলি তাদের নিজস্ব জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন শুরু করে এবং গ্লোবাল মার্কেটে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে।
চীনের ফার্মাসিউটিক্যাল বাজার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং এটি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটির ওষুধ শিল্পের একটি বড় অংশ জেনেরিক ড্রাগের নিয়ন্ত্রণে। চীনের সরকার ওষুধের খরচ কমানোর লক্ষ্যে জেনেরিক ওষুধের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে।
চীনের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে চীন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (CFDA), যা বর্তমানে ন্যাশনাল মেডিকেল প্রোডাক্টস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NMPA) নামে পরিচিত। এই সংস্থা ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নিয়মাবলী প্রণয়ন করেছে। চীন জেনেরিক ওষুধের বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেনেরিক ওষুধ সরবরাহ করে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। চীনা কোম্পানিগুলি আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে এবং অনেকগুলো কোম্পানি ইতিমধ্যে US FDA এবং EU EMA থেকে অনুমোদন পেয়েছে।
চীনের জেনেরিক ড্রাগ শিল্পের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন মান নিয়ন্ত্রণ, প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা। তবে সরকার ও শিল্পের যৌথ প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করছে।
ভারতে বেশ আগে থেকেই জেনেরিক উৎপাদন হলেও পেটেন্ট আইনের কিছু বাধার মুখে এই কাজ ব্যহত হতে থাকে৷ ভারত ১৯৭০ সালে পেটেন্ট আইন সংশোধন করে, যা দেশটিকে একটি প্রধান জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করে। ভারতীয় কোম্পানিগুলি কম খরচে ওষুধ উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে শুরু করে। সমগ্র পৃথিবীর ২০% জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে ভারত যেজন্য এ দেশকে “ফার্মেসি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড” বলা হয়। বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
বাংলাদেশে জেনেরিক ড্রাগ উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের ওষুধ শিল্প বিশেষ করে জেনেরিক ড্রাগ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে । বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮২ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ (Drug Control Ordinance) প্রণয়ন করা হয়। এই অধ্যাদেশটি দেশের ওষুধ উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং বিপণন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি উচ্চ মানের জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন করে এবং বিশ্বব্যাপী বাজারে রপ্তানি করে। দেশের প্রায় ৯৮% অভ্যন্তরীণ চাহিদা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধ দ্বারা পূরণ হয়। বাংলাদেশ জেনেরিক ওষুধ প্রায় ১৫০টি দেশে রপ্তানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে উচ্চ মানের ওষুধ সরবরাহের জন্য বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো GMP (Good Manufacturing Practices) অনুসরণ করে এবং অনেকগুলি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে
বর্তমানে, জেনেরিক ওষুধ বিশ্বব্যাপী ওষুধের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহের জন্য জেনেরিক ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ওষুধের জেনেরিক নাম শিখে নেওয়া সহজ
বর্তমানে একই ওষুধ পণ্যের বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন কোড নাম, রাসায়নিক নাম, অব্যবসায়িক নাম, জেনেরিক নাম, বাণিজ্যিক নাম বা ব্র্যান্ড নাম ইত্যাদি।
কোড নাম : কোড নাম হচ্ছে কোম্পানি বা গবেষকদের দেওয়া নাম। কোম্পানির বিশেষ বিশেষ পদাধিকারী ছাড়া কেউ এ নামের আড়ালে কী রাসায়নিক পদার্থ আছে তা জানেন না। যেমন বায়ার কোম্পানি সিপ্রোফ্লক্সাসিন-এর কোড নাম দিয়েছিল Bay-0-9867। যদিও ওষুধ ব্যবহারে কোড নামের কোনো গুরুত্ব নেই।
রাসায়নিক নাম : রসায়নবিদরা এই নাম ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। রাসায়নিক নাম বড় ও জটিল হওয়ার জন্য প্রেসক্রিপশনে লেখা সমস্যাজনক। তবে বস্তুর রাসায়নিক ধর্ম বোঝার জন্য এ ধরনের নাম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সিপ্রোফ্লক্সাসিন-এর রাসায়নিক নাম 1 – cyclopropyol-6-Fluro-1, 4 dihydro-4- 0x07 piperazine.
ওষুধের অব্যবসায়িক নাম : রাসায়নিক নামের চেয়ে এই নাম ছোট। রাসায়নিক নাম থেকে শব্দ নির্বাচন করে এই নাম দেওয়া হয়। এই নাম নির্বাচন করার নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। যেমন রাসায়নিক নামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সহজ ও সংক্ষেপে উচ্চারণযোগ্য এবং রোগে ব্যবহারের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। অনেকে এই নামকে গুলিয়ে ফেলে জেনেরিক নাম বলেন। রাসায়নিক গোত্র দিয়ে ওষুধের জেনেরিক নাম ঠিক হয়।
ওষুধের বাণিজ্যিক নাম : এই নামকে ট্রেড নাম বা ব্র্যান্ড নাম বা কমার্শিয়াল নামেও ডাকা যেতে পারে। মূল রাসায়নিকটিকে বেশি পরিমাণে উৎপাদন করলে বুনিয়াদি ওষুধ (বাল্ক ড্রাগ) তৈরি হয়। এই বুনিয়াদি ওষুধ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি কিনে ভিন্ন ভিন্ন ফর্মুলেশন বানায়। ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ওষুধ ফর্মুলেশনগুলোর ভিন্ন নাম দেয়। ওই নামগুলোই বাণিজ্যিক নাম। অনেক সময় বুনিয়াদি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিরা নিজেরাই বাণিজ্যিক নামের ওষুধ ফর্মুলেশন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে। যেমন বায়ার কোম্পানির সিপ্রোফ্লক্সাসিনের নাম BAYCIP। সিপ্রোফ্লাক্সাসিনের অন্যান্য বাণিজ্যিক নাম হচ্ছে সিপ্রোমেড, বায়োসিপ, সিফান ইত্যাদি। একটি ওষুধের ভিন্ন ভিন্ন বাণিজ্যিক নাম হয়। কিন্তু কোর্ড নাম, রাসায়নিক নাম বা অব্যবসায়িক নাম সাধারণ ভাবে একটি বা দুটি হয়।
যে সব রোগে (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি) কার্যত সারাজীবন ওষুধ ব্যবহার করতে হয় সেখানে চিকিৎসকরা একই ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন বাণিজ্যিক নামে প্রেসক্রিপশন করে রোগীদের বোঝান ‘এবার ওষুধ পাল্টে দিলাম’, ভালো হয়ে যাবেন। জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলে চিকিৎসকরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে বোঝাবেন ‘এ রোগে ভালো থাকবেন, ভালো হবে না।’ ওষুধ বিজ্ঞান পড়ানোর সময় ছাত্রদের জেনেরিক বা অব্যবসায়িক নামে ওষুধ চেনানো হয়। ডাক্তারি পাস করার পর মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার অনুমোদন নেওয়ার সময় ডাক্তারদের যে এথিক্স বা নীতিমালা দেওয়া হয় তাতে জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে বলা থাকে । ‘Use of Generic names of drugs: Every physician should, as far as pos- sible, prescribe drugs with generic names and he/she shall ensure that there is a rational prescription and use. of drugs’। অথচ যখনই একজন চিকিৎসক প্রয়োগে যান তখন তিনি ওষুধ লেখার ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড বা বাণিজ্যিক নামে ওষুধ লেখেন। একই ওষুধের ব্র্যান্ড নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে ব্র্যান্ড লিখলে ডাক্তারের লাভ (বিভিন্ন ধরনের) তিনি সেটিই রোগীর জন্য নির্বাচন করে দেন। সচেতন বা অসচেতন ভাবে সাফাই দেন নির্বাচিত ব্র্যান্ডটি তার রোগীর পক্ষে শ্রেষ্ঠ। রোগীদের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্র্যান্ড নির্বাচনে চিকিৎসকদের আত্মস্বার্থ অগ্রাধিকার পায়। ওষুধ কোম্পানি ও তার প্রচারকের স্বার্থে, সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে রোগীদের দাবিয়ে চিকিৎসকরা এক ধরনের ওষুধ বিক্রেতা হয়ে যান। ওষুধ বাজারে কার্যত রোগীদের ওষুধ নির্বাচনকারী হিসেবে ওষুধ কোম্পানির কথামতো এজেন্টে পরিণত হন কম বেশি সব চিকিৎসকই। চিকিৎসা বিক্রির চালিকা শক্তিতে ব্র্যান্ড বা বাণিজ্যিক নামে ওষুধ লেখা, গতি এনে দেয় বিভিন্ন কারণে।
ওষুধের দাম গোপন পুঁজিবাদের অনিবার্য শর্ত
ওষুধ বিজ্ঞান পড়ানোর সিলেবাসে আজ অবধি ওষুধের দাম নিয়ে ছাত্রদের কিছু শেখানো হয় না। আমার ছাব্বিশ বছরের ডাক্তারি শিক্ষকতা এবং আটত্রিশ বছরের ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আজও ওষুধের দাম সরকার ও ওষুধ কোম্পানি জনগণের কাছে গোপন করে রেখেছে। মুনাফার স্বার্থে ওষুধের প্রকৃত উৎপাদন খরচ ও লাভের পরিমাণ কখনোই জনগণকে জানানো হয় না।
ওষুধ কোম্পানি ও সরকারের নেতৃত্বে ওষুধের উৎপাদন খরচ ও লাভের পরিমাণ গোপন করা হয়। গোপন না করলে সীমাহীন মুনাফা করা যাবে না। আর এই মুনাফার সাথে জড়িত রয়েছে মানুষের শ্রমের অর্থ আত্মসাৎ করার সহজাত নিয়ম। তাই যুগ যুগ ধরে সিলেবাসে ওষুধের দাম ও লাভের প্রশ্ন অনুপস্থিত। কিন্তু ওষুধ বাজারের সংকট যখন বাড়ে, ক্রেতা কমে যায়, তখন ওষুধ কোম্পানিদের মধ্যে বাজার দখলের প্রতিযোগিতা চলে। এই সংকটকালে মানুষ জানতে পারেন ওষুধ বিক্রিতে হাজার হাজার শতাংশ লাভের বহর। জনগণের মধ্যে প্রশ্ন জাগে ওষুধের একই ফর্মুলেশনে ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডের দাম কেন ভিন্ন ভিন্ন। ভাবখানা এমন যে, জনগণকে দাম অনুযায়ী ওষুধের ব্র্যান্ড নির্বাচনের অধিকার দেওয়ার প্রশ্নে দামের এই ফারাক। আসলে বিভিন্ন আয়ের ক্রেতা ধরার জন্য একই ওষুধের ভিন্ন ভিন্ন দাম রাখা হয়। বেশি দামি ওষুধ বেশি ভালো- এই সংস্কৃতি জনগণের মধ্যে চর্চা করিয়ে দামি ব্র্যান্ড বিক্রি করে ব্যাপক মুনাফা লোটে ওষুধ-ব্যবসায়ীরা। জেনেরিক মেডিসিন লিখলে এ সংস্কৃতি কিছুটা ধাক্কা খাবে।
জেনেরিক মেডিসিন লিখতে হবে এ বিতর্ক এল কেন
জনগণ ও রোগীরা এ প্রশ্ন তোলেননি। কারণ রোগীদের কাছে কষ্ট-যন্ত্রণায় আরাম আর রোগ মুক্তি প্রধান বিষয়। সরকারই প্রথম জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে হবে এই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। ওষুধ কোম্পানিরাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে কম দামে জেনেরিক মেডিসিন বাজারে বিক্রি করার ব্যবস্থা করে জনগণের মধ্যে ওষুধের দাম নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৫ সালে সরকারি- চিকিৎসকদের জেনেরিক মেডিসিন লিখতে হবে, এই মর্মে সার্কুলার দেয়। মেডিকেল কলেজ থেকে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্র অবধি এ সার্কুলার কোথাও মানা হয়নি। সরকারের দিক থেকে মানানোর কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। ওষুধ বাজারে বেশির ভাগ কেন বলি, সবই বাণিজ্যিক নামে ওষুধ ছিল এবং আছে। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আবার সরকারি হাসপাতালে জেনেরিক মেডিসিন লেখার সার্কুলার দেয়। এবার চিকিৎসকদের ওপর আইনি খাঁড়া ঝোলানো হয়, জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতেই হবে। না লিখলে আইনি ও প্রশাসনিক শাস্তি। এই সময়ে চালু হল সরকারি- বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন হাসপাতালে ‘ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান’। ৫০ – ৭৭% ছাড়ের ওষুধ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ ওষুধ-বাজারের মতোই ন্যায্য মূল্যের দোকানেও জেনেরিক নামের ওষুধ ফর্মুলেশন চালু হল না। কিন্তু ডাক্তারদের ওপর চাপ সৃষ্টি হল জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতেই হবে। কারণ সরকারি ডাক্তারদের জেনেরিক নামের প্রেসক্রিপশনগুলো বাইরের বাজার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসবে ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোতে। বর্তমান সরকারের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখানোর জোর-জবরদস্তির পেছনে আসলে সংকটাপন্ন ওষুধ বাজারের প্রয়োজন মেটানো। ওষুধ বিজ্ঞানকে যুক্তিপূর্ণ ভাবে প্রয়োগ করার গণশিক্ষা মালা নয়। এছাড়া ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলো ৫০–৭৭% ছাড় দিয়েও ব্যাপক লাভ করে। ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো থেকে যে সমস্ত বাণিজ্যিক নামের ওষুধ চালু ছিল সেগুলোর নাম ওষুধ কোম্পানি ও সরকার বলতে লাগল ব্র্যান্ডেড জেনেরিক নামে। জনগণের কাছে ওষুধের একটি প্রতারণাপূর্ণ নাম ‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক মেডিসিন’ চালু হল। এখনো বাজারে কোনো জেনেরিক মেডিসিন চালু হয়নি। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে জনগণের মধ্যে জেনেরিক মেডিসিন এবং এই নামে ওষুধ লিখতে হবে প্রশ্নগুলো এল। শুরু হল বিতর্ক।
জেনেরিক নামে কেন ওষুধ লেখা উচিত
ওষুধ বাজারে শুধু জেনেরিক নামে কোনো ওষুধ নেই। ব্র্যান্ড নাম ও জেনেরিক নাম, ওষুধের মোড়কে এক সাথে রয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক নাম বড় করে। অব্যবসায়িক নাম খুবই ছোট করে। ইচ্ছাকৃত ভাবেই সরকার ও ওষুধ কোম্পানি বাজারে বাণিজ্যিক নামে ওষুধ চালু রেখেছে। ফলে জনগণকে বাধ্য হয়ে বাণিজ্যিক বা ব্র্যান্ড নামের ওষুধ ফর্মুলেশন কিনতে হয়। যাতে জনগণ ভুলভাবে ব্র্যান্ড নামে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতেও চিকিৎসকরা জেনেরিক মেডিসিন বা অব্যবসায়িক নামে ওষুধ লিখলে জনগণ ও চিকিৎসকদের অনেক লাভ হবে।
- রোগী, জনগণ ও চিকিৎসকরা ওষুধ ফর্মুলেশনের প্রকৃত রাসায়নিকটির নাম জানতে পারবেন। ফলে ওষুধের কাজ, পার্শ্বক্রিয়া, নিরাপত্তা, ওষুধের মাত্রা ও দাম নিয়ে সচেতনতা বাড়বে। জনগণ ওষুধ বিজ্ঞানের শিক্ষামালায় সজ্জিত হবেন। এ ঘটনা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
- রোগী, জনসাধারণ, ফার্মাসিস্ট, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক – কাউকেই একই ওষুধের ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড নাম মনে রাখতে হবে না। দোকানে সব ব্র্যান্ড রাখার দরকারও নেই। খুচরো ওষুধ ব্যবসায় কম পুঁজি বিনিয়োগ করেও ভালো ভাবে দোকান চালানো যাবে।
- চিকিৎসক ব্র্যান্ড নামে ওষুধ লিখলে রোগীরা ভাবতে পারেন ডাক্তারের সাথে ওষুধ কোম্পানির যোগসাজশ রয়েছে। বাস্তবে হয়তো ওই চিকিৎসকের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। জেনেরিক মেডিসিন লিখলে এ ধরনের সহজাত দ্বন্দ্ব কম হবে। রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হবে।
- জেনেরিক মেডিসিন বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানে রোগীদের সংগ্রহ করতে অসুবিধে হবে না। ঘুরে ঘুরে ব্র্যান্ড খুঁজতে হবে না। চিকিৎসকরাও জানতে পারবেন ওষুধের রাসায়নিকটির পরিচয়।
- কোনো রোগের সমাধান না হলে রোগীরা অন্য ডাক্তারের কাছে গেলে জেনেরিক মেডিসিন লিখলে পুনর্বার একই ওষুধ প্রয়োগের সমস্যায় পড়তে হবে না।

জেনেরিক মেডিসিনের বিরুদ্ধে যারা- ডাক্তাররা সবার আগে
চিকিৎসকদের সাথে বিভিন্ন আলোচনা সভাতে— ছোট বা বড়, দেখা গেছে প্রায় সব চিকিৎসকই একটি বিষয় বলেন, সরকারকে আগে বলুন, বাজারে জেনেরিক নামে ওষুধ চালু করতে। কেউ কেউ বলেন আমরা জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলাম আর ফার্মাসিস্ট নিজের পছন্দমতো ব্র্যান্ড বিক্রি করে মুনাফা করল, তাতে রোগীদের অর্থের ক্ষতি হবে। তাছাড়া ফার্মাসিস্টের পছন্দমতো ব্র্যান্ডটিতে রোগীদের সমস্যা না মিটলে তখন দায়িত্ব কে নেবে? অনেক ওষুধের দোকানে প্রশিক্ষিত ওষুধ বিক্রেতা নেই, ফলে তারা জেনেরিক নামের ওষুধ দিতে পারবে না। তাহলে জরুরি রোগীদের ওষুধ না পাওয়ার সমস্যা কে সমাধান করবে?
কম-বেশি বিশ বছর এ রকম হাজারো অপযুক্তি ডাক্তারদের মুখে শুনে শুনে আমরা এটুকু বুঝেছি, জ্ঞানের ব্যক্তিমালিকানা হারিয়ে চিকিৎসকরা যত ‘প্রযুক্তি শ্রমিক’-এ পরিণত হচ্ছেন ততই চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যপণ্য বিক্রেতা হয়ে উঠছেন। আর বেশি বেশি বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। চিকিৎসা বাজারের সংকট যত বাড়ছে তত জেনেরিক মেডিসিন এর দামের প্রশ্ন প্রকাশ্যে আসছে। ডাক্তাররা জ্ঞানের ব্যক্তি মালিকানা হারানোর সাথে সাথে ওষুধের ব্র্যান্ড নির্বাচন করার ক্ষমতা হারিয়ে আজ জেনেরিক নামে ওষুধ না লেখার বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন।