বাংলাদেশে এক ধরনের অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যায়। কেউ যখন নতুন কিছু শুরু করেন, তার দেখাদেখি শত শত মানুষ সেটা অনুকরণ করে নষ্ট করে ফেলেন।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর দেশে বেশ কয়েকটি মানসম্পন্ন স্বাধীন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। বর্তমানে শুধু ঢাকা শহরেই ৫০০টির বেশি দৈনিক সংবাদপত্র রয়েছে। কেউ একজন বেসরকারি হাসপাতাল চালু করেছিলেন। এখন সেখানে ৫ হাজারের বেশি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ১০ হাজারের বেশি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে বলে জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব থেকে। এ ছাড়া বহু সংখ্যক অনিবন্ধিত ও অবৈধ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা একই রকম। অগ্রণী ও দূরদর্শী সাবেক আমলা ও কূটনীতিক মুসলেহ উদ্দিন আহমদ ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়’ (এনএসইউ) প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৫২টি রাজধানীতে (অসমর্থিত সংবাদ থেকে জানা যায় ২২টি ধানমন্ডি, লালমাটিয়া ও এর আশেপাশের এলাকায় অবস্থিত), ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মুহূর্তে কোনো উপাচার্য নেই এবং ৭৬টিতে উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষ নেই।
নির্লজ্জভাবে আইন লঙ্ঘন করেও সেগুলো কীভাবে টিকে আছে? এর কারণ আর কিছুই না, রাজনৈতিক সমর্থন। নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১১৪টি আবেদনপত্র জমা পড়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগের পেছনেই রয়েছে রাজনৈতিক সমর্থন।
আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার জন্য সরকারি সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ খুবই জরুরি। এর অর্থ এই নয় যে ‘টাকা তৈরির’ জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়োগটা প্রয়োজন শিক্ষাখাতকে এগিয়ে নিতে। আর এ ক্ষেত্রে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
১৫টি শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিদের ওপর পরিচালিত এক সংক্ষিপ্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ব্যবসায়ীদের বিস্ময়কর উপস্থিতি। যারা মূলত মুনাফা অর্জনের আগ্রাসী লক্ষ্য নিয়ে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ করেছেন। তাদের এই মনোভাবের কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীতিতে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন এবং তারা বাধ্য হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিচে নামিয়ে আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ দিতে। যা মূলত ‘সার্টিফিকেটধারী’ মানুষের সংখ্যা বাড়িয়েছে, জ্ঞানী বা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারেনি।
তবে, এটা সম্পূর্ণ চিত্র নয়। বেশ কিছু ভালো মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটাতে ভালো মানের শিক্ষা দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। শিক্ষাবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের যোগ্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি সার্বিকভাবে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষার মান বেড়েছে। বিদেশের বেশ কয়েকটি মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমাদের দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে গুণগত উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও কাজ করছেন।
তাহলে কি বিষয়টা এরকম যে, গুটিকয়েক খারাপ মানুষ ভালোদের নষ্ট করছে। নাকি আমাদের বলা উচিৎ, অসংখ্য খারাপ মানুষ কিছু সংখ্যক মানুষের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছেন?
এ ক্ষেত্রে আমরা এনএসইউ এর উদাহরণ বিবেচনা করতে পারি।
গুরুত্ব সহকারে আত্মবিশ্লেষণ ও সংস্কারের সময় এসেছে। সমস্যা হচ্ছে, কীভাবে আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা ও ইতিবাচক অর্জন আরও শক্তিশালী করবো এবং নেতিবাচক বিষয় আগাছার মতো উপড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাব।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। যাতে এর মাধ্যমে ঠিক করা যায়, কারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পৃষ্ঠপোষক হতে পারবেন। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ নেই।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে আবেদনের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য ৫ কোটি এবং অন্যান্য মহানগরের জন্য ৩ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল, ২৫ হাজার বর্গফুটের নিজস্ব বা ভাড়া নেওয়া জায়গা এবং ৯ থেকে ২১ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ড থাকতে হবে। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাদারী অভিজ্ঞতা, সুনাম অথবা শিক্ষাখাতের প্রতি তাদের আগ্রহ আছে কি না, সে ধরনের কোনো আবশ্যকতা নেই।
অর্থাৎ, যার হাতে কিছু বাড়তি টাকা আছে, সেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক হতে পারবেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমনই হয়েছে। তাদের মধ্যে অল্প কিছু মানুষ শিক্ষাকে সামনে এগিয়ে নিতে এলেও, অনেকে নিজের প্রচার করতে এসেছেন এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করে সেই উদ্দেশ্য ভালোভাবেই পূরণ করেছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাফল্য পাওয়ার পর প্রচুর পরিমাণে টাকা আসতে শুরু করলে এই দৃশ্যপটে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। আমাদের দেশের সেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি ক্রেডিটের জন্য ৬ হাজার ৫০০ টাকা করে নিয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থীকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে ১২০ ক্রেডিট প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ তাকে মোট ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।
মধ্যম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রেডিট প্রতি ৪ হাজার টাকা করে নেয় এবং সেখানে মোট খরচ হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। গড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থী (কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ হাজার বা তারও বেশি শিক্ষার্থী আছে) এবং সঙ্গে সব ধরনের ফি, যেমন প্রতি সেমিস্টারের নিবন্ধন ফি যোগ করা হলে সেটি একটি বিশাল বার্ষিক আয় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই বিশাল পরিমাণ টাকা ব্যাংকে রাখলে যে সুদ পাওয়া যায়, সেটাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের কিছু সদস্য, সবাই নয়, আবিষ্কার করলেন বাতাসে টাকা উড়ছে এবং তাদের মনে হলো সেই টাকার একটি অংশ তাদেরও প্রাপ্য। তবে একইসঙ্গে তারা এটাও জানতেন, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন করা হয়েছে, ফলে তারা সরাসরি লভ্যাংশ নিতে পারছেন না। তখন তারা দামি গাড়ি, পরিবারসহ বিলাসবহুল বিদেশ যাত্রা, ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় অংশগ্রহণের জন্য ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘ইনভেলপ মানি’ এবং কোনো ক্ষেত্রে ১২ থেকে ২৫ জন পর্যন্ত সদস্য নিয়ে গঠিত কমিটির সভায় উপস্থিত থেকে বড় অংকের ফি নেওয়ার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সুবিধা নিতে শুরু করেন।
আমরা যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছি, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠানরত যেকোনো কমিটির যেকোনো সভায় যোগদান করতে পারেন। তিনি ওই কমিটির সদস্য কি না তার ওপর কিছু নির্ভর করে না। পরবর্তীতে তিনি ওই দিনে অনুষ্ঠিত যেকোনো সংখ্যক মিটিংয়ে উপস্থিতির ফি তুলে নিতে পারেন।
ট্রাস্টি বোর্ডের কিছু সদস্য বছরে এসব ফি বাবদ করসহ প্রায় দেড় কোটি টাকা তুলে নিতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় বাধ্য হয়েই সেই অর্থ পরিশোধ করতো। অনেক সদস্যের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ব্যক্তিগত কার্যালয় রয়েছে। সেখানে বসে তারা শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের খুঁটিনাটি কাজের সরাসরি তদারকি শুরু করেন, যা উপাচার্যের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে প্রায় ৩ লাখ ২৮ হাজার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৭ হাজার ৫০০ জন নারী। এ ছাড়া তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, ২৪ শতাংশ ব্যবসায় প্রশাসন, ১১ শতাংশ মানবিক, ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ বিজ্ঞান, ৬ শতাংশ আইন, ৩ শতাংশ সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা করছেন এবং অন্যান্য বিষয়ে এক শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী রয়েছেন।
এই মুহূর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানকে ছোট করা বা তাদের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়া উচিৎ নয়। বরং ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও উপাচার্যের ক্ষমতায় যথাযথ সমন্বয় তৈরির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই সমন্বয়ের অভাবেই মূলত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা নিজেদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সর্বেসর্বা’ ভাবেন, দাবি করেন এবং সেভাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। যার ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুশাসন পরিস্থিতির করুণ দশা এবং অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে।
এনএসইউ এর ক্ষেত্রে বলা যায়, অভিযুক্ত ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের প্রতি কোনো ধরনের পক্ষপাত না দেখিয়ে, বোর্ডের বাকি সদস্যদের উচিৎ একে ঢেলে সাজানো এবং একজন নতুন চেয়ারম্যানের (প্রয়োজনে অস্থায়ীভাবে) নিয়োগ দেওয়া। একই সঙ্গে স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও প্রশাসকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটির আওতায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ অডিট প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে হবে। সরকার এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগেই ট্রাস্টি বোর্ডকে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদে এনএসইউ এর প্রতিষ্ঠাতা মুসলেহ উদ্দিন আহমদের মস্তিষ্কপ্রসূত পরীক্ষামূলক উদ্যোগ ‘এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স ফাউন্ডেশন (ইকিউএএফ)’ কাজে লাগানো যেতে পারে। ইকিউএএফের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষণের একটি প্রক্রিয়া চালুর সুপারিশ করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সংস্থার সাহায্য নিতে হবে। যারা সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুসরণ করা মানদণ্ড মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছানোর প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এ ধরনের মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে এবং তা বজায় রাখতে হবে। আমাদের একই সঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ, দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ করতে হবে, যারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি এনে দেবেন।