শিরোনাম ::
সীতাকুণ্ড বিস্ম্ফোরণের কাঠামোগত ভিত্তি
কল্লোল মোস্তফা: লেখক, প্রকৌশলী; নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা
- আপডেট সময় : ০৬:৪৪:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জুন ২০২২
- / ৫০০৭ বার পড়া হয়েছে
শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি মালিকানাধীন বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুন ছড়িয়ে বিপজ্জনক রাসায়নিকভর্তি কনটেইনার বিস্ম্ফোরণে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়। যার ফলে অন্তত ৪১ জন নিহত এবং কয়েকশ মানুষ আহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে কনটেইনার ডিপোর শ্রমিক-কর্মচারীসহ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীও রয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, ডিপোতে মজুত রাসায়নিক বিষয়ে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। জানালে তাঁরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতেন।
অগ্নিকাণ্ড-পরবর্তী বিস্ম্ফোরণের জন্য প্রাথমকিভাবে যে রাসায়নিকটি চিহ্নিত হয়েছে তা হলো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। উত্তপ্ত হলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বিস্ম্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, এই বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুতের জন্য বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের কাছ থেকে কোনো লাইসেন্স নেয়নি নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপের যৌথ মালিকানাধীন এই বেসরকারি কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ বিষয়ে অধিদপ্তরকে কোনো কিছু অবহিতও করা হয়নি। উল্লেখ্য, বিএম কনটেইনার ডিপোর একজন পরিচালক হলেন স্মার্ট গ্রুপের এমডি এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক মুজিবুর রহমান।
সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ওই ডিপোতে বিপজ্জনক রাসায়নিকপূর্ণ কনটেইনার পৃথকভাবে নিরাপদে রাখার নিয়মকানুন মানা হয়নি। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও মোকাবিলার জন্য যে ধরনের ফায়ার সেফটি প্ল্যান বা অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকার কথা, সেটাও ছিল না বা থাকলেও কার্যকর ছিল না। কার্যকর ফায়ার সেফটি প্ল্যান থাকলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে জানা সম্ভব হতো- ডিপোর কোন স্থানে কোন ধরনের সামগ্রী মজুত করা আছে। ফলে তাঁরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। রাসায়নিকের আগুন পানি দিয়ে নেভানোর মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। ডিপোতে আগুন লাগার পর কনটেইনার উত্তপ্ত হয়ে বিস্ম্ফোরিত হওয়ার সময়ের মধ্যে অন্তত দেড় ঘণ্টা ব্যবধান ছিল। বিপজ্জনক রাসায়নিকসম্পন্ন ডিপোটিতে যদি নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর থাকত, তাহলে হয়তো আগুন লাগার পরপরই তা নির্বাপণ করে বিস্ম্ফোরণ এড়ানো যেত। এ ছাড়া নিয়মিত অগ্নি মহড়া হলে ডিপোর শ্রমিক-কর্মচারীরা আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিরাপদে বের হতে পারতেন। এগুলো খুব পরিচিত অভিযোগ; বড় কোনো অগ্নিকাণ্ডেই শোনা যায়। আর পরিসংখ্যানের আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকে একেকজন রক্ত-মাংসের মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনা; একেকটি পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা।
এসব করুণ অকালমৃত্যু কি শুধুই দুর্ঘটনা? আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একই রকম কারণে বারবার ঘটতে থাকে; যে কারণগুলো ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত, তখন সেগুলো
আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকে না। সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা থাকে না। হয়ে ওঠে ব্যবস্থাপনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
এ দেশে দুর্ঘটনার পর আরেকটি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কার্যকারণ শনাক্ত করে তা দূর করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনার পর রুটিন অনুসারে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হলেও কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। তদন্তেও অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসে না। ফলে সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যায় না। আবার তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এসব কারণে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে, যা বেশিরভাগ দুর্ঘটনার পেছনের কাঠামোগত পূর্বশর্তের প্রাধান্যের দিকটাই নির্দেশ করে।
এর আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৭১ জন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের আগুনের ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য ৩১ দফা সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে বিপজ্জনক গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া; অবৈধ, অননুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমন্বিত অভিযান পরিচালনা; অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা; একই কক্ষে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মজুত না রাখা; রাসায়নিক ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তি নেওয়া; নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ব্যর্থতায় ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করা ইত্যাদি।
মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, ঠিক এ রকমই কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছর আগে, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জনের প্রাণহানির পর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই তদন্ত কমিটি সে সময় অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে একই ধরনের ১৭ দফা সুপারিশ করে। ওই দুই অগ্নিকাণ্ড-পরবর্তী তদন্ত কমিটির সুপারিশ মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ৯ বছরেও সুপারিশমালা বাস্তবায়ন হয়নি বলেই সুপারিশগুলো তাদের আবার করতে হয়েছে। নিমতলীর সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে চুড়িহাট্টায় এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হতো না। একইভাবে নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে কলকারখানা, গুদাম, কনটেইনার ডিপো ইত্যাদি স্থানে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত, বাজারজাতকরণ এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে তদারকি প্রক্রিয়া জোরদার করা হলে; রাসায়নিক ও দাহ্যবস্তু মজুত, অনুমোদন, লাইসেন্সিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও ফায়ার সেফটি প্ল্যান নিশ্চিত করা হলে আজ সীতাকুণ্ডের রাসায়নিক বিস্ম্ফোরণটি ঘটত না বা ঘটলেও যথাযথ প্রস্তুতি থাকার কারণে এত মানুষের প্রাণহানি হতো না।
বিভিন্ন দুর্ঘটনা বিশ্নেষণে দেখা যায়, এমন সব কাঠামোগত কারণে বারবার মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে, যার অধিকাংশই কর্তৃপক্ষের জানা থাকার কথা। সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিলে সেসব দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমিয়ে আনাও সম্ভব। কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা চলমান থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য লাভজনক। ফলে এসব গোষ্ঠীর প্রভাবে কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। আবার দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয় তা সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হলেও তাৎক্ষণিক লাভ-লোকসান বিবেচনায় অনেকেই এ বিনিয়োগটুকু করতে চায় না। এ কারণেই নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি এ ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্ঘটনা ঘটলে কোনো প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি বা ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না দেখে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিনিয়োগে তাদের কোনো তাগিদ থাকে না। সংশ্নিষ্টদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি করা হলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনে বাধ্য হয়।
এ দেশে খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার জন্য কোনো কারখানা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে অনুমোদন ও তদারককারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়! বিশ্বের যেসব দেশে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়; সেসব দেশে দুর্ঘটনার হার অনেক কম। বাংলাদেশে এমন কোনো জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বলেই দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তিগুলো দিনের পর দিন অক্ষুণ্ণই থেকে যায়।
অগ্নিকাণ্ড-পরবর্তী বিস্ম্ফোরণের জন্য প্রাথমকিভাবে যে রাসায়নিকটি চিহ্নিত হয়েছে তা হলো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। উত্তপ্ত হলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বিস্ম্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, এই বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুতের জন্য বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের কাছ থেকে কোনো লাইসেন্স নেয়নি নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপের যৌথ মালিকানাধীন এই বেসরকারি কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ বিষয়ে অধিদপ্তরকে কোনো কিছু অবহিতও করা হয়নি। উল্লেখ্য, বিএম কনটেইনার ডিপোর একজন পরিচালক হলেন স্মার্ট গ্রুপের এমডি এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক মুজিবুর রহমান।
সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, ওই ডিপোতে বিপজ্জনক রাসায়নিকপূর্ণ কনটেইনার পৃথকভাবে নিরাপদে রাখার নিয়মকানুন মানা হয়নি। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও মোকাবিলার জন্য যে ধরনের ফায়ার সেফটি প্ল্যান বা অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকার কথা, সেটাও ছিল না বা থাকলেও কার্যকর ছিল না। কার্যকর ফায়ার সেফটি প্ল্যান থাকলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে জানা সম্ভব হতো- ডিপোর কোন স্থানে কোন ধরনের সামগ্রী মজুত করা আছে। ফলে তাঁরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। রাসায়নিকের আগুন পানি দিয়ে নেভানোর মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। ডিপোতে আগুন লাগার পর কনটেইনার উত্তপ্ত হয়ে বিস্ম্ফোরিত হওয়ার সময়ের মধ্যে অন্তত দেড় ঘণ্টা ব্যবধান ছিল। বিপজ্জনক রাসায়নিকসম্পন্ন ডিপোটিতে যদি নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর থাকত, তাহলে হয়তো আগুন লাগার পরপরই তা নির্বাপণ করে বিস্ম্ফোরণ এড়ানো যেত। এ ছাড়া নিয়মিত অগ্নি মহড়া হলে ডিপোর শ্রমিক-কর্মচারীরা আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিরাপদে বের হতে পারতেন। এগুলো খুব পরিচিত অভিযোগ; বড় কোনো অগ্নিকাণ্ডেই শোনা যায়। আর পরিসংখ্যানের আড়ালে হারিয়ে যেতে থাকে একেকজন রক্ত-মাংসের মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনা; একেকটি পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা।
এসব করুণ অকালমৃত্যু কি শুধুই দুর্ঘটনা? আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একই রকম কারণে বারবার ঘটতে থাকে; যে কারণগুলো ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত, তখন সেগুলো
আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকে না। সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা থাকে না। হয়ে ওঠে ব্যবস্থাপনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
এ দেশে দুর্ঘটনার পর আরেকটি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কার্যকারণ শনাক্ত করে তা দূর করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনার পর রুটিন অনুসারে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হলেও কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। তদন্তেও অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসে না। ফলে সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যায় না। আবার তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এসব কারণে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে, যা বেশিরভাগ দুর্ঘটনার পেছনের কাঠামোগত পূর্বশর্তের প্রাধান্যের দিকটাই নির্দেশ করে।
এর আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৭১ জন। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের আগুনের ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য ৩১ দফা সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে বিপজ্জনক গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া; অবৈধ, অননুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমন্বিত অভিযান পরিচালনা; অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা; একই কক্ষে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মজুত না রাখা; রাসায়নিক ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তি নেওয়া; নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ব্যর্থতায় ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করা ইত্যাদি।
মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, ঠিক এ রকমই কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছর আগে, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জনের প্রাণহানির পর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই তদন্ত কমিটি সে সময় অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে একই ধরনের ১৭ দফা সুপারিশ করে। ওই দুই অগ্নিকাণ্ড-পরবর্তী তদন্ত কমিটির সুপারিশ মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ৯ বছরেও সুপারিশমালা বাস্তবায়ন হয়নি বলেই সুপারিশগুলো তাদের আবার করতে হয়েছে। নিমতলীর সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে চুড়িহাট্টায় এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হতো না। একইভাবে নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে কলকারখানা, গুদাম, কনটেইনার ডিপো ইত্যাদি স্থানে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত, বাজারজাতকরণ এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে তদারকি প্রক্রিয়া জোরদার করা হলে; রাসায়নিক ও দাহ্যবস্তু মজুত, অনুমোদন, লাইসেন্সিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও ফায়ার সেফটি প্ল্যান নিশ্চিত করা হলে আজ সীতাকুণ্ডের রাসায়নিক বিস্ম্ফোরণটি ঘটত না বা ঘটলেও যথাযথ প্রস্তুতি থাকার কারণে এত মানুষের প্রাণহানি হতো না।
বিভিন্ন দুর্ঘটনা বিশ্নেষণে দেখা যায়, এমন সব কাঠামোগত কারণে বারবার মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে, যার অধিকাংশই কর্তৃপক্ষের জানা থাকার কথা। সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিলে সেসব দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমিয়ে আনাও সম্ভব। কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা চলমান থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য লাভজনক। ফলে এসব গোষ্ঠীর প্রভাবে কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। আবার দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয় তা সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হলেও তাৎক্ষণিক লাভ-লোকসান বিবেচনায় অনেকেই এ বিনিয়োগটুকু করতে চায় না। এ কারণেই নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি এ ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্ঘটনা ঘটলে কোনো প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি বা ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না দেখে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিনিয়োগে তাদের কোনো তাগিদ থাকে না। সংশ্নিষ্টদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি করা হলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনে বাধ্য হয়।
এ দেশে খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার জন্য কোনো কারখানা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে অনুমোদন ও তদারককারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়! বিশ্বের যেসব দেশে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়; সেসব দেশে দুর্ঘটনার হার অনেক কম। বাংলাদেশে এমন কোনো জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বলেই দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তিগুলো দিনের পর দিন অক্ষুণ্ণই থেকে যায়।