ঢাকা ০৫:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ড. ইউনূস-মোদি বৈঠকের সম্ভাবনা ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ৬ ডিসেম্বর ধানমন্ডি ৩২: প্রতিশোধের ক্রোধে উন্মাদ প্রায় শেখ হাসিনা বেনজীরকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারিতে নির্দেশনা শেখ হাসিনার সরকার হটাতে মার্কিন নীলনকশার গোপন নথি ফাঁস শেখ হাসিনার সঙ্গে কী পরিকল্পনা করছিলেন শাওন ? এবার আটক অভিনেত্রী সোহানা সাবা অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন আটক শেখ হাসিনার ফাঁদে পড়ে আরও ক্ষয়ে যাচ্ছে আ. লীগ হাসিনা-রেহানাকে শেয়ারবাজারের ৩ লাখ কোটি টাকা দেন শিবলী রুবাইয়াত হাসিনার ভাষণের মুখোমুখি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন! শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কী বলছে আওয়ামী লীগ? হাসিনা-রেহানাদের ৪ বাগানবাড়ি, আছে ডুপ্লেক্স ভবন, শানবাঁধানো ঘাট, পুকুর বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কর্মকর্তার লকার ফ্রিজ তিতুমীর আন্দোলনের পেছনে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ শেখ হাসিনাকে রেখেই ফিরছে আওয়ামী লীগ? শেখ হাসিনাকন্যা পুতুলের আড়াই মিনিটের নাচের ভিডিও ভাইরাল হাসিনার সাথে ভারতে গোপন বৈঠক করলেন ওবায়দুল কাদের লাল গালিচায় খালে নেমে খননের উদ্বোধন তিন উপদেষ্টার প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি হওয়ার আগে–পরে কী ঘটেছিল, জানালেন ইউনূস

হাসিনা-রেহানাদের ৪ বাগানবাড়ি, আছে ডুপ্লেক্স ভবন, শানবাঁধানো ঘাট, পুকুর

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ১০:৩৭:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / 31
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সারি সারি গাছের ভেতর দিয়ে রাস্তা। গ্রামীণ পরিবেশ। তার ভেতরে বিশাল এক বাগানবাড়ি। বাড়ির ভেতরে রয়েছে ডুপ্লেক্স বা দ্বিতল ভবন, শানবাঁধানো ঘাট ও পুকুর।

বাগানবাড়িটির নাম টিউলিপ’স টেরিটরি। অবস্থান গাজীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কানাইয়া এলাকায়। টিউলিপ’স টেরিটরি নামকরণ হয়েছে সম্প্রতি পদত্যাগ করা ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নামে। নথিপত্রে বাড়িটির মালিক শফিক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার স্বামী ও টিউলিপের বাবা।

টিউলিপ’স টেরিটরিসহ গাজীপুরে চারটি বাগানবাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর মালিক শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা। বাগানবাড়িগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য, স্বজন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই বাগানবাড়িগুলোতে বেড়াতে যেতেন। বিশেষ করে শীত মৌসুমে তাঁদের যাতায়াত বেশি ছিল। মাঝেমধ্যে রাতে জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়ি প্রবেশ করত। তখন বাংলোর চারপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকত। কখনো কখনো ভোরেই গাড়িগুলো চলে যেত। কখনো কখনো দু-এক দিন থাকত।

বাগানবাড়ি-১: কানাইয়ায় টিউলিপ’স টেরিটরি

গাজীপুরের কানাইয়া সিটি করপোরেশনের মধ্যে হলেও সেখানকার পরিবেশ গ্রামীণ এলাকার মতোই। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের বাড়িঘর মাটির। কেউ কেউ আধা পাকা ও পাকা ভবন করেছেন। গাজীপুরের যেসব এলাকায় রিসোর্ট বেশি, তার মধ্যে একটি কানাইয়া।

টিউলিপ’স টেরিটরিতে ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কানাইয়ায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ও কয়েকটি টিনের ঘর রয়েছে। সব জায়গায় ভাঙচুরের চিহ্ন, ডুপ্লেক্স বাড়ির একাংশ পোড়া। বাড়ি পাহারায় কোনো লোকজন নেই। বিশাল একটি পুকুরেরর ভেতরে দুটি নৌকা।

বাগানবাড়িটির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপর একদল লোক বাগানবাড়িটিতে ভাঙচুর করেছে। তখন থেকে আর বাড়ির মালিকপক্ষ বা নিরাপত্তাকর্মীদের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। আগে অনেক নিরাপত্তা ছিল। বাড়িটি কার, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই জানে এটা শেখ রেহানার বাড়ি।’

রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রতিবছর শীতের সময়ে দেখতাম বাড়িটি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা। পতাকা লাগানো গাড়িও আমরা আসতে দেখেছি।’

গাজীপুর পৌর ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে টিউলিপ’স টেরিটরির ২৬৩ শতক (প্রায় আট বিঘা) জমির নামজারির নথি পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, জমির মালিকানা শফিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে। টিউলিপ’স টেরিটরির সীমার ভেতরে এখনো নামজারি না হওয়া শফিক আহমেদ সিদ্দিকের মালিকানাধীন জমি আছে কি না, তা জানা সম্ভব হয়নি।

টিউলিপ’স টেরিটরির সীমানা ইটের দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সীমানা চিহ্নিত এলাকায় জমির পরিমাণ আট বিঘার কয়েক গুণ হবে। বিষয়টি নিয়ে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, হতে পারে জমি কেনা হয়েছে, এখনো নামজারি হয়নি।

বাগানবাড়ি-২: তেলিরচালা

গাজীপুর শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মৌচাকের তেলিরচালা এলাকায় বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পূর্ব পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে রয়েছে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের একটি বাগানবাড়ি। এলাকাটি শিল্পঘন।

স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ জমি লিখে দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক হয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জমির কিছু অংশ সন্তানদের লিখে দেন। সেই সূত্রে মালিক হন সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, রাদওয়ান সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক। নথিপত্রে জমির পরিমাণ ২৯৭ শতক (৯ বিঘা)। তবে এ ক্ষেত্রেও স্থানীয়দের ভাষ্য, বাস্তবে জমির পরিমাণ অনেক বেশি হবে।

‘ডামি ভোট’ নামে পরিচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া শেখ হাসিনার হলফনামা ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি নিজের নামে সাড়ে ১৫ বিঘা কৃষিজমি দেখিয়েছেন, যা টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও রংপুরে অবস্থিত।

গাজীপুরের মৌচাকের তেলিরচালায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বাগানবাড়িছবি: প্রথম আলো

তেলিরচালা গিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি সকালে দেখা যায়, বাগানবাড়িটি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতরে একটি দ্বিতল ভবন, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর, সুইমিংপুল (সাঁতার কাটার জন্য নির্মিত পাকা জলাধার) ও খোলা জায়গা রয়েছে। বাড়িটির ফটকে কোনো নাম নেই। ফটকটি ভাঙা। ভেতরে কয়েকটি শিশু খেলছিল। কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও ছিলেন। তাঁরা জানান, ৫ আগস্ট এই বাড়িতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তারপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। মাঝে এক দফায় কোনো এক রাতে ইটের দেয়াল তুলে ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা কে বা কারা ভেঙে ফেলেছে।

বাড়িটির কাছে পাওয়া যায় স্থানীয় বাসিন্দা আলমাছ হোসেনকে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বছরে কয়েকবার বাড়িটি ঘিরে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হতো। তখন লোকজন বলাবলি করত, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তখন ধারেকাছেও যেতে পারতাম না। তাঁরা না থাকলেও বাড়িটি ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা থাকত।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, বাগানবাড়িটি দেখাশোনা করতেন কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ। ৫ আগস্টের পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

বাগানবাড়ি-৩: ফাওকাল

গাজীপুর মহানগরের ফাওকাল এলাকায় বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা ও টাঁকশাল নামে পরিচিত দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেডের পাশেই রয়েছে আরেকটি বাগানবাড়ি। সেটিকে আগে স্থানীয় মানুষজন ‘ডাক্তার বাড়ি’ হিসেবে চিনতেন। তবে নথিপত্রে বাড়ির মালিক তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

১ ফেব্রুয়ারি সকালে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ফটকে বাড়িটির কোনো নাম লেখা নেই। ফটকটি নতুন করে ইটের দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশের একটি গাছে উঠে দেখা যায়, বাড়িটির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে অনেক বড় জমি। আছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর ও গাছপালা। ভেতরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চিহ্ন রয়েছে।

বাড়িটির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে অনেক বড় জমি। আছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর ও গাছপালাছবি: প্রথম আলো

নথিপত্রে বাড়িটিতে জমির পরিমাণ ১৭৮ শতক বা ৫ দশমিক ৪ বিঘা। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, এ ক্ষেত্রেও জমির পরিমাণ অনেক বেশি।

ভূমি কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা অনিল কুমার ও অক্ষয় কুমার বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জমিটি কেনা হয় তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে। এর মধ্যস্থতা করেন স্বপন মিয়া নামের স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ী। স্বপন এখন আত্মগোপনে।

ওই জমির সাবেক মালিক অক্ষয় কুমার বিশ্বাসকে পাওয়া যায় জয়দেবপুরে। তিনি গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ওই জমি তাঁর বাবা-চাচাদের ছিল। ২০১৫ সালে তারিক আহমেদ সিদ্দিক কিনে নেন। ২৩ বিঘা জমি থাকলেও ১৪ বিঘার দাম দেন তিনি। কাগজপত্র সমস্যা থাকার কারণে বাকি জমির দাম পাননি। তিনি আরও বলেন, যে জমির দাম পাননি, তা-ও এখন বাড়িটির সীমানার ভেতরে রয়েছে।

বাগানবাড়ি-৪: বাঙ্গালগাছে ‘বাগানবিলাস’

মহানগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় রয়েছে আরেকটি বাংলোবাড়ি। নাম ‘বাগানবিলাস’। ১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটির ফটক বন্ধ। ডাকাডাকি করলে মো. হৃদয় নামের এক ব্যক্তি ফটকের দরজা খুলে দেন। তিনি জানান, তিনি ওই বাড়ি দেখাশোনা করেন। তিনি এই প্রতিবেদককে ভেতরে ঢুকতে দেননি।

বাইরে থেকেই দেখা যায়, বাগানবাড়িটির ভেতরে শত শত গাছ লাগানো। রয়েছে একটি দোতলা ভবন। পাশেই আরেকটি ছোট ঘর। সামনে বিশাল পুকুর। পাশের বিল ও পুকুর দেখার জন্য রয়েছে ‘ওয়াচ-টাওয়ার’।

বাইরে থেকেই দেখা যায়, বাগানবাড়িটির ভেতরে শত শত গাছ লাগানো। সামনে বিশাল পুকুর।ছবি: প্রথম আলো

বাগানবাড়িটি দেখাশোনাকারী মো. হৃদয় প্রথম আলোকে বলেন, সবাই জানে এটি শেখ রেহানার বাংলো। কিন্তু এটি আসলে তাঁর এক আত্মীয়ের। ৫ আগস্ট একদল লোক বাড়িটিতে প্রবেশ করে ভাঙচুর করে এবং লুটপাট চালায়।

বাড়িটির ফটকে শফিক সিদ্দিকের নাম লেখা, যিনি তারিক সিদ্দিকের ভাই। তবে ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়ির ৭৮ শতক (২ দশমিক ৩৬ বিঘা) জমির নামজারি হয়েছে তারিক সিদ্দিকের নামে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জমির পরিমাণ অনেক বেশি।

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বেশির ভাগের নামে ৫ আগস্টের পর হত্যা মামলা হয়েছে। দুদক তাঁদের দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলাও হয়েছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

হাসিনা-রেহানাদের ৪ বাগানবাড়ি, আছে ডুপ্লেক্স ভবন, শানবাঁধানো ঘাট, পুকুর

আপডেট সময় : ১০:৩৭:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সারি সারি গাছের ভেতর দিয়ে রাস্তা। গ্রামীণ পরিবেশ। তার ভেতরে বিশাল এক বাগানবাড়ি। বাড়ির ভেতরে রয়েছে ডুপ্লেক্স বা দ্বিতল ভবন, শানবাঁধানো ঘাট ও পুকুর।

বাগানবাড়িটির নাম টিউলিপ’স টেরিটরি। অবস্থান গাজীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কানাইয়া এলাকায়। টিউলিপ’স টেরিটরি নামকরণ হয়েছে সম্প্রতি পদত্যাগ করা ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নামে। নথিপত্রে বাড়িটির মালিক শফিক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার স্বামী ও টিউলিপের বাবা।

টিউলিপ’স টেরিটরিসহ গাজীপুরে চারটি বাগানবাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর মালিক শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা। বাগানবাড়িগুলোর আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য, স্বজন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই বাগানবাড়িগুলোতে বেড়াতে যেতেন। বিশেষ করে শীত মৌসুমে তাঁদের যাতায়াত বেশি ছিল। মাঝেমধ্যে রাতে জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়ি প্রবেশ করত। তখন বাংলোর চারপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকত। কখনো কখনো ভোরেই গাড়িগুলো চলে যেত। কখনো কখনো দু-এক দিন থাকত।

বাগানবাড়ি-১: কানাইয়ায় টিউলিপ’স টেরিটরি

গাজীপুরের কানাইয়া সিটি করপোরেশনের মধ্যে হলেও সেখানকার পরিবেশ গ্রামীণ এলাকার মতোই। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের বাড়িঘর মাটির। কেউ কেউ আধা পাকা ও পাকা ভবন করেছেন। গাজীপুরের যেসব এলাকায় রিসোর্ট বেশি, তার মধ্যে একটি কানাইয়া।

টিউলিপ’স টেরিটরিতে ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কানাইয়ায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি ও কয়েকটি টিনের ঘর রয়েছে। সব জায়গায় ভাঙচুরের চিহ্ন, ডুপ্লেক্স বাড়ির একাংশ পোড়া। বাড়ি পাহারায় কোনো লোকজন নেই। বিশাল একটি পুকুরেরর ভেতরে দুটি নৌকা।

বাগানবাড়িটির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপর একদল লোক বাগানবাড়িটিতে ভাঙচুর করেছে। তখন থেকে আর বাড়ির মালিকপক্ষ বা নিরাপত্তাকর্মীদের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। আগে অনেক নিরাপত্তা ছিল। বাড়িটি কার, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই জানে এটা শেখ রেহানার বাড়ি।’

রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রতিবছর শীতের সময়ে দেখতাম বাড়িটি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তা। পতাকা লাগানো গাড়িও আমরা আসতে দেখেছি।’

গাজীপুর পৌর ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে টিউলিপ’স টেরিটরির ২৬৩ শতক (প্রায় আট বিঘা) জমির নামজারির নথি পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, জমির মালিকানা শফিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে। টিউলিপ’স টেরিটরির সীমার ভেতরে এখনো নামজারি না হওয়া শফিক আহমেদ সিদ্দিকের মালিকানাধীন জমি আছে কি না, তা জানা সম্ভব হয়নি।

টিউলিপ’স টেরিটরির সীমানা ইটের দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সীমানা চিহ্নিত এলাকায় জমির পরিমাণ আট বিঘার কয়েক গুণ হবে। বিষয়টি নিয়ে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, হতে পারে জমি কেনা হয়েছে, এখনো নামজারি হয়নি।

বাগানবাড়ি-২: তেলিরচালা

গাজীপুর শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মৌচাকের তেলিরচালা এলাকায় বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পূর্ব পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে রয়েছে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের একটি বাগানবাড়ি। এলাকাটি শিল্পঘন।

স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালের দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ জমি লিখে দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক হয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জমির কিছু অংশ সন্তানদের লিখে দেন। সেই সূত্রে মালিক হন সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, রাদওয়ান সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক। নথিপত্রে জমির পরিমাণ ২৯৭ শতক (৯ বিঘা)। তবে এ ক্ষেত্রেও স্থানীয়দের ভাষ্য, বাস্তবে জমির পরিমাণ অনেক বেশি হবে।

‘ডামি ভোট’ নামে পরিচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া শেখ হাসিনার হলফনামা ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি নিজের নামে সাড়ে ১৫ বিঘা কৃষিজমি দেখিয়েছেন, যা টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও রংপুরে অবস্থিত।

গাজীপুরের মৌচাকের তেলিরচালায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বাগানবাড়িছবি: প্রথম আলো

তেলিরচালা গিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি সকালে দেখা যায়, বাগানবাড়িটি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভেতরে একটি দ্বিতল ভবন, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর, সুইমিংপুল (সাঁতার কাটার জন্য নির্মিত পাকা জলাধার) ও খোলা জায়গা রয়েছে। বাড়িটির ফটকে কোনো নাম নেই। ফটকটি ভাঙা। ভেতরে কয়েকটি শিশু খেলছিল। কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও ছিলেন। তাঁরা জানান, ৫ আগস্ট এই বাড়িতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তারপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। মাঝে এক দফায় কোনো এক রাতে ইটের দেয়াল তুলে ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা কে বা কারা ভেঙে ফেলেছে।

বাড়িটির কাছে পাওয়া যায় স্থানীয় বাসিন্দা আলমাছ হোসেনকে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বছরে কয়েকবার বাড়িটি ঘিরে কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হতো। তখন লোকজন বলাবলি করত, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তখন ধারেকাছেও যেতে পারতাম না। তাঁরা না থাকলেও বাড়িটি ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা থাকত।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, বাগানবাড়িটি দেখাশোনা করতেন কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ। ৫ আগস্টের পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

বাগানবাড়ি-৩: ফাওকাল

গাজীপুর মহানগরের ফাওকাল এলাকায় বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা ও টাঁকশাল নামে পরিচিত দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেডের পাশেই রয়েছে আরেকটি বাগানবাড়ি। সেটিকে আগে স্থানীয় মানুষজন ‘ডাক্তার বাড়ি’ হিসেবে চিনতেন। তবে নথিপত্রে বাড়ির মালিক তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

১ ফেব্রুয়ারি সকালে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ফটকে বাড়িটির কোনো নাম লেখা নেই। ফটকটি নতুন করে ইটের দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশের একটি গাছে উঠে দেখা যায়, বাড়িটির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে অনেক বড় জমি। আছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর ও গাছপালা। ভেতরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চিহ্ন রয়েছে।

বাড়িটির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে অনেক বড় জমি। আছে ডুপ্লেক্স বাড়ি, শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর ও গাছপালাছবি: প্রথম আলো

নথিপত্রে বাড়িটিতে জমির পরিমাণ ১৭৮ শতক বা ৫ দশমিক ৪ বিঘা। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, এ ক্ষেত্রেও জমির পরিমাণ অনেক বেশি।

ভূমি কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা অনিল কুমার ও অক্ষয় কুমার বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জমিটি কেনা হয় তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে। এর মধ্যস্থতা করেন স্বপন মিয়া নামের স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ী। স্বপন এখন আত্মগোপনে।

ওই জমির সাবেক মালিক অক্ষয় কুমার বিশ্বাসকে পাওয়া যায় জয়দেবপুরে। তিনি গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ওই জমি তাঁর বাবা-চাচাদের ছিল। ২০১৫ সালে তারিক আহমেদ সিদ্দিক কিনে নেন। ২৩ বিঘা জমি থাকলেও ১৪ বিঘার দাম দেন তিনি। কাগজপত্র সমস্যা থাকার কারণে বাকি জমির দাম পাননি। তিনি আরও বলেন, যে জমির দাম পাননি, তা-ও এখন বাড়িটির সীমানার ভেতরে রয়েছে।

বাগানবাড়ি-৪: বাঙ্গালগাছে ‘বাগানবিলাস’

মহানগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় রয়েছে আরেকটি বাংলোবাড়ি। নাম ‘বাগানবিলাস’। ১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটির ফটক বন্ধ। ডাকাডাকি করলে মো. হৃদয় নামের এক ব্যক্তি ফটকের দরজা খুলে দেন। তিনি জানান, তিনি ওই বাড়ি দেখাশোনা করেন। তিনি এই প্রতিবেদককে ভেতরে ঢুকতে দেননি।

বাইরে থেকেই দেখা যায়, বাগানবাড়িটির ভেতরে শত শত গাছ লাগানো। রয়েছে একটি দোতলা ভবন। পাশেই আরেকটি ছোট ঘর। সামনে বিশাল পুকুর। পাশের বিল ও পুকুর দেখার জন্য রয়েছে ‘ওয়াচ-টাওয়ার’।

বাইরে থেকেই দেখা যায়, বাগানবাড়িটির ভেতরে শত শত গাছ লাগানো। সামনে বিশাল পুকুর।ছবি: প্রথম আলো

বাগানবাড়িটি দেখাশোনাকারী মো. হৃদয় প্রথম আলোকে বলেন, সবাই জানে এটি শেখ রেহানার বাংলো। কিন্তু এটি আসলে তাঁর এক আত্মীয়ের। ৫ আগস্ট একদল লোক বাড়িটিতে প্রবেশ করে ভাঙচুর করে এবং লুটপাট চালায়।

বাড়িটির ফটকে শফিক সিদ্দিকের নাম লেখা, যিনি তারিক সিদ্দিকের ভাই। তবে ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়ির ৭৮ শতক (২ দশমিক ৩৬ বিঘা) জমির নামজারি হয়েছে তারিক সিদ্দিকের নামে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জমির পরিমাণ অনেক বেশি।

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বেশির ভাগের নামে ৫ আগস্টের পর হত্যা মামলা হয়েছে। দুদক তাঁদের দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলাও হয়েছে।