কাঠমিস্ত্রি থেকে প্রকৌশলী, স্বপ্নের প্রান্তে সুমন
- আপডেট সময় : ১২:৩৯:২৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 79
ইসিজি মনিটরে হৃদস্পন্দনের রেখা খেয়াল করে দেখেছেন? এই উঠছে, এই নামছে। রেখার উত্থান-পতন মানেই বেঁচে থাকা। রেখা একদম সরল হয়ে যাওয়া মানেই মৃত্যু। মোহাম্মদ সুমনের গল্পটাও এমন। কত উত্থান, কত পতন। এর নামই তো বেঁচে থাকা।
বেশ সচ্ছল পরিবার থেকে আকস্মিকভাবে পথে বসা। যে বয়সে ক্রিকেট ব্যাট হাতে তুলে নেওয়ার কথা, সুমন (ছদ্মনাম) সে সময়ে শক্ত করে ধরেছিল কাঠের রান্দা। যে বয়সে মজা করে পিঠা খাওয়ার কথা, সুমন পথের ধারে চুলোর আঁচে পুড়তে পুড়তে পিঠা ভেজে বিক্রি করেছে। এক সময়ের সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী মাকে দেখেছে, সেলাই মেশিনে জীবনের বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াইকে গেঁথে যেতে।
ছোট্ট কাঁধে পাহাড়-বোঝা চেপে বসেছিল বলেই সুমন জীবন নামের পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পেরোনোর সাহস পেয়েছে। হাল ছাড়েনি। চালিয়ে যাচ্ছে সংগ্রাম। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টার শেষ করেছে। এক সময় যে ভাবত, জীবনটাই হয়তো কেটে যাবে চেয়ার-টেবিল বানাতে বানাতে; সে এখন স্বপ্ন দেখে, তাঁর হাতে তৈরি হবে বড় বড় ভবন, সেতু।
নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জে কাঠের বড় ব্যবসা ছিল বাবার। ছ’মিল ছিল, আসবাবপত্রের ব্যবসাও ছিল। ছিল নদীপথে গাছ বয়ে আনার ট্রলারের মালিকানা। বাবা কঠোর পরিশ্রমে ব্যবসায় উন্নতি করছিলেন। তিন সন্তানকে নিয়ে ছিল তার অনেক স্বপ্ন।
সুমন তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। হঠাৎ এক ঝড় সব এলোমেলো করে দেয়। ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্বে একজনকে রেখেছিলেন সুমনের বাবা। সেই মানুষটাই প্রতারণা করে বসে। আত্মসাৎ করে কোটি ছুঁইছুঁই টাকা।
সুমনের বাবা চোখে অন্ধকার দেখলেন। ব্যবসার সব পুঁজি তো হারালেনই, মাথার ওপর ৪২ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। পাওনাদারেরা ঘিরে ধরে। ছোট্ট সুমনের অনেক সকাল শুরু হয়েছে বাসার সামনে পাওনাদারদের হুমকি-ধমকি শুনে। অজানা আশঙ্কায় ছোট্ট মন কেঁপে উঠেছে বারবার।
সহায়-সম্পত্তি যা ছিল সব বেচে সুমনের বাবা ঋণ শোধ করতে থাকেন। কিন্তু আর ব্যবসা গোছানোর জোর পাননি। সুমনরা ফিরে যায় গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। একদম শূন্য হাতে। সেখানেও তাদের থাকার একমাত্র ঘরটি বেচে দিতে হয়। শেষমেষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় খোলা জায়গায় টিনের একটা ঘর করে।
এবার শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। সে লড়াইয়ে নামতে হয় ছোট্ট সুমনকেও। বাবা যেহেতু কাঠের কাজ জানতেন, সুমনও শুরু করলেন কাঠমিস্ত্রির কাজ। কলম ছেড়ে তাকে হাতে তুলে নিতে হয় করাত, রান্দা, ছেনি ও হাতুড়ি। সন্ধ্যা হলে বসতে হতো পথের ধারের পিঠার দোকানে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সুমন দিনমজুরের কাজও করেছে।
ঋণের বোঝা তখনো পুরোপুরি নামেনি সুমনের বাবার কাঁধ থেকে। যা আয় করতেন, সিংহভাগই চলে যেত ধারদেনা শোধ করতে করতে। এক সময় সংসারের হাল ধরতে হয় সুমনের মাকে। ঢাকা থেকে কাপড় এনে পিরোজপুরে বিক্রি শুরু করেন। সেলাই মেশিনে বানাতেন পোশাক। ঋণ শোধ করতে করতে সেটা এখন এক লাখেরও নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু এর ধকল সামলাতে গিয়ে সুমনের বাবা এখন প্রায় শয্যাশায়ী।
এতকিছুর মধ্যেও সুমনের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে গেছেন তার মা। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় সুমন ভালো। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। মা চাইতেন না সুমন ব্যবসার দিকে যাক। বারবার বলতেন, ‘বাবা, তোকে ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করতেই হবে। ভালো একটা চাকরি নিতেই হবে। পড়াশোনাতেই তোর মুক্তি।’
সন্ধ্যায় পিঠার চুলার ম্রিয়মাণ আলোতেই চলত সুমনের অংক কষা। স্কুলের বেতন জোগাতে পারতেন না বলে মা বেতন মওকুফ করার জন্য শিক্ষকদের কাছে হাতজোড় করতেন। অন্যের সামনে মাকে ছোট হতে দেখে সুমনের মন কাঁদত। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক শিক্ষিকার কাছে প্রাইভেট পড়ত। তিন-চার মাসের টাকা জমে যায়। একদিন সেই শিক্ষিকা বলেন, ‘সুমন, আজ তোমাকে পড়তে হবে না। আজ তোমার ছুটি।’ সুমনের সেই ছুটি আর শেষ হয়নি।
অনেক শিক্ষক সুমনের পাশেও দাঁড়িয়েছেন। এসএসসির সময় এক শিক্ষকের প্রাইভেটে সুমন পড়েছে বিনা টাকায়। তবে জীবনে চলার পথে সাহায্যের হাত কমই জুটেছে। কিন্তু সুমন হাল ছাড়েনি। পড়াশোনাই যে মুক্তির একমাত্র পথ।
এইচিএসসি শেষে সুমন ঢাকায় আসে। খালার বাসায় থেকে ভর্তির প্রস্তুতি নেয়। চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে সুযোগও পায়। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন এতটাই ভঙ্গুর, সুমন বুঝতে পারে, ঢাকায় থাকলে অন্তত নিজে কিছু একটা করতে পারবে পড়াশোনার পাশাপাশি।
তখনই সুমন খোঁজ পায় প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির। জানতে পারে, উচ্চশিক্ষার পথে অর্থসংকট যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, এই বিশ্ববিদ্যালয় সেটি বিশেষ বিবেচনা করে। প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি শুধু সুমনকে ভর্তির সুযোগই দেয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে চাকরির ব্যবস্থাও করে দেয়।
আর এক বছর পরেই পুরোদস্তুর প্রকৌশলী হয়ে যাবে সুমন। এরপর? শুধু কি বাড়িঘর কিংবা সেতু? না, সুমন নির্মাণ করবে স্বপ্ন। জীবন তাঁকে একটা জিনিস শিখিয়েছে—মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।















