জাকসুর ভোট গণনা নিয়ে তামাশা
- আপডেট সময় : ০৬:৫৪:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 79
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনায় ২১ ঘণ্টা লেগেছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) ভোট গণনা গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শুরু হলেও শেষ হতে ভোর হয়ে যেতে পারে বলে জানা গেছে। ভোট গণনায় এত সময় লাগা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এর পেছনে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন ধরনের যুক্তি দেখালেও ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আপত্তির পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকেই বেশি দায়ী করা হচ্ছে।
এ নির্বাচনের ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পড়তে হয়েছে বিপাকে আর ফলপ্রত্যাশীদের চাতক পাখির মতো থাকতে হয়েছে দীর্ঘ অপেক্ষায়। ভোট গণনা ও ফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সামনে এসেছে, প্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভ বেড়েছে। ফলে বড় ধরনের কোনো সমস্যা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলেও ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা নিয়ে এই লেজেগোবরে অবস্থা।
গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। নির্ধারিত সময় বিকাল ৫টায় শেষ হয় ভোটগ্রহণ। এরপরও সারিতে থাকা ভোটাররা ভোট দেন। তবে কয়েকটি হলে ভোটগ্রহণ দেরিতে শুরু হওয়া এবং সাময়িক স্থগিত হওয়ায় দেরিতে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। ভোটগ্রহণ শেষে বাম ঘরানার চারটি প্যানেল ভোট বর্জন করে। তবে চার প্যানেলের তিনটিই পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে ব্যর্থ হয়।
কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫ পদে লড়েছেন ১৭৭ প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে ৯ এবং জিএস পদে আট প্রার্থী রয়েছেন। ছাত্রীদের ১০টি আবাসিক হলে ১৫০ পদের মধ্যে ৫৯টিতে কোনো প্রার্থী নেই। একজন করে প্রার্থী ছিল ৬৭টি পদে। সে হিসাবে মাত্র ২৪ পদে ভোট নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ হলের মধ্য দুটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ হাজার ৭৪৩ জন। ভোট পড়ে ৬৭ থেকে ৬৮ শতাংশ।
গত বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর রাত সোয়া ১০টার দিকে শুরু হয় গণনার কাজ, যা গতকাল রাত ৮টার দিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শেষ হয়নি। তবে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে ২১ হল সংসদের ভোট গণনা শেষ হয়। এর মধ্যে পাঁচটি হলের ভিপি ও জিএস পদে বিজয়ীদের তথ্য অনানুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল আসতে ভোর হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে রাতের মধ্যেই জাকসু ও ২১ হল সংসদের ভোট গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান। সেটা রাতের শেষভাগেও হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে জাকসু নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করার সময় তার সঙ্গে ওই প্যানেলের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। মাজহারুল বলেন, ‘সুস্পষ্টভাবে আমরা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাচ্ছি। আমরা ভোটের আগের দিন থেকে প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে বলে আসছিলাম যে, কোন জায়গাগুলোতে… ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেগুলোর স্বচ্ছতা আপনারা নিশ্চিত করুন।’ এ সময় নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অব্যবস্থাপনার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
ভোট গণনা ও ফল বিলম্বিত হওয়ার কারণ
ওএমআর মেশিন দিয়ে ভোট গণনার প্রস্তুতি থাকলেও বেশ কয়েকজন প্রার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যানুয়ালি (হাতে ভোট গণনা) করার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে একটু বেশি সময় লাগবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব একেএম রাশিদুল আলম। কিন্তু গতকাল শুক্রবার দুপুরের মধ্যে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা সম্ভব হবে বলে আশার কথা শোনান তিনি। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে ভোট গণনা শেষ হয়নি, ফলও প্রকাশ করা হয়নি। ভোট গণনাসংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশ নিতে এসে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় প্রীতিলতা হলের পোলিং অফিসার জান্নাতুল ফেরদৌস অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চারুকলা বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপকের জানাজা হয় বাদ জুমা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে।
শিক্ষকের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে বিরাজ করে শোকের ছায়া। এর মধ্যেই চলতে থাকে ভোট গণনা ও ফল প্রকাশের কাজ। পরে রাশিদুল আলম বলেন, শুক্রবার বিকাল নাগাদ হলের ভোট গণনার কাজ শেষ করা এবং রাত ১০-১১টার মধ্যে সম্পূর্ণ গণনা শেষ করে বেসরকারিভাবে ফল ঘোষণা করা যাবে।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল কেন্দ্রের রিটার্নিং কর্মকর্তা সুলতানা আক্তার বলেন, ‘হল সংসদে একটিমাত্র ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট হচ্ছে কিন্তু জাকসুতে তিনটি করে। অর্থাৎ আট হাজার ভোট কাস্ট হলে ২৪ হাজার কাউন্ট করতে হবে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব? তিনদিনেও তো এটা সম্ভব হবে না। আমরা এ পদ্ধতির পরিবর্তন চাই।’
একেএম রাশিদুল আলম কয়েকটি কারণে ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে- ওএমআর মেশিন দিয়ে ভোট গণনার প্রস্তুতি থাকলেও আপত্তির মুখে ম্যানুয়ালি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া, তাতে বেশি সময় লাগা; সকাল ৯টায় ভোটগ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও দুটি হলে কিছুটা দেরি হওয়া, দুয়েকটি হলে মাঝপথে ভোট স্থগিত হওয়া, দুটি বড় হলে বিকালের পর দীর্ঘ লাইন তৈরি হওয়ায় সব ভোট বাক্স আসতে রাত সাড়ে ৯টা বেজে যাওয়া; ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভোট গণনার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি বা জানাশোনা না থাকায় ধীরগতিতে এগোনো; সিনেট ভবনের কক্ষে শুরুতে পাঁচটি টেবিলে ভোট গণনা শুরু হওয়া এবং পরে তা বাড়িয়ে ১০টি করা, বর্ধিত টেবিলের পাশে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও লোকবল বৃদ্ধি করা; বৃহস্পতিবার রাতে অনেক হলের পোলিং কর্মকর্তা উপস্থিত থাকলেও পোলিং এজেন্টরা অনুপস্থিত থাকায় ব্যালট বাক্স খোলা ও সব হিসাব করার ক্ষেত্রে জটিলতা; পোলিং অফিসার জান্নাতুল ফেরদৌসের মৃত্যু ও বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শোকের ছায়ায় নির্বাচনি কাজ করা।
প্রার্থীদের অভিযোগ ও কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা
জাকসু নির্বাচনে ভোট গণনার মেশিন ও ব্যালট পেপার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি ও জিএস প্রার্থী। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে তারা দাবি করেন, প্রতিষ্ঠানটি জামায়াতে ইসলামীর নেতা রোকমুনুর জামান রনির। অন্যদিকে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম ওই ব্যক্তির বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট প্রিন্ট করে সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন, যাতে দেখা যায় রোকমুনুর ব্যবসায়ী ও বিএনপিকর্মী। একটি ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার চেয়ারের একদম পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি নিশ্চয়ই বিএনপির বড় কোনো নেতা হবেন। এরপরও তাকে জামায়াত নেতা দাবি করছেন প্রতিপক্ষের নেতারা।’
রোকমুনুরের ফেসবুক আইডির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন সময় পোস্ট দিয়েছেন তিনি। এমনকি কোনো এক সম্মেলনে খালেদা জিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যায় তাকে। খালেদা জিয়াকে নিয়ে ২০১৯ সালে করা ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন ফেসবুকে প্রচার হলে রোকমুনুর শেখ হাসিনার ব্যঙ্গাত্মক ছবি যুক্ত করে ২০২৫ সালের ১৪ এপ্রিল একটা পোস্ট দিয়ে বলেন, ‘কাউকে অপমান অপদস্থ করতে গেলে প্রকৃতির নিয়মে সেটা ফেরত আসে।’
ফলে কোনো একটি প্যানেলের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা মেশিনে না করার নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে অপরিপক্ব হিসেবে দেখছেন অনেকে। এভাবে ভোটগ্রহণ শেষে গণনার সময় এসে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ফল ঘোষণার প্রক্রিয়াকে আরো বিলম্বিত করেছে। এতে অন্য প্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরো বাড়িয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকজন প্রার্থী ও শিক্ষার্থী কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ করেন।
এমনকি জাকসু নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল কেন্দ্রের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক সুলতানা আক্তার। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায় নিতে হবে। একই সঙ্গে জান্নাতুল ফেরদৌসের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।







