২০১৭ সাল। ঢাকার দেয়ালে দেখা গেল উদোম গা ও উসকোখুসকো চুলের এক যুবককে। জেলের গরাদের ভিতরে সে দাঁড়িয়ে। দেয়ালের একখানে লেখা, সুবোধ এখন জেলে। তখনই সব লোকের টনক নড়ে গিয়েছিল, তা নয়। তবে যাদের নজরে পড়েছিল তারা চিন্তিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, কে এই সুবোধ? শুধুই কি একটি মানুষ না মানুষ প্রতীকে সুন্দর, সুশীল অনুভূতি যার অভাবে রাষ্ট্র শুকিয়ে যায়? সুবোধের অভাবেই মানুষ নির্বোধ হয়, শাসক নিপীড়নযন্ত্রের চালক হয় আর সুযোগ খোঁজে কাকে ধরাশায়ী করা যায়।
সুবোধ প্রকাশিত হওয়ার আগের বছরগুলোয় রাষ্ট্র চেপে ধরেছিল সংবাদমাধ্যমের টুঁটি, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও মানুষ কথা বলে পার পেত না। রাতের বেলায় মানুষকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হতো, বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও সে আর ঘরে ফিরত না। শিশুরা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ত, সকাল হলে আবার কান্না শুরু করত। এমন সময়ে দেখা মিলল সুবোধের, সরকারের টিকটিকি বাহিনী ঘাম ছুটিয়েও শিল্পীকে খুঁজে পেত না। সুবোধ একটি গ্রাফিতি, যাকে বলা হয় পাবলিক আর্ট, যা কথা বলে অসংগতির বিরুদ্ধে, যা কোনো অনুমতির তোয়াক্কা করে না। সাধারণ মানুষ দেখতে পায় এমন কোনো জায়গায় গ্রাফিতি প্রকাশিত হয়। তবে বেশি সময় এগুলোর টিকে থাকার সুযোগ হয় না—হয় প্রতিপক্ষ মুছে দেয়, অথবা পোস্টার-ব্যানারে ঢেকে যায়।
গেল সরকারের আমলে যখন আলোচনা-সমালোচনার দ্বার রুদ্ধ ছিল তখন সুবোধই কেবল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে পেরেছিল। কারণ তার শিল্পী ‘হবেকি’ ছিল অশরীরীর মতো, দেয়ালে ভাষা ফুটিয়ে মিলিয়ে যেত। সুবোধের দ্বিতীয় গ্রাফিতিতে দেখা গেল, সে পালাচ্ছে। কারণ এখানে মনুষ্যত্ব নেই, তাই তাকে পালাতে হচ্ছে। সুবোধকে পালাতে হচ্ছে, কারণ তার ভাগ্যে কিছু নেই। পরের গ্রাফিতিতে সুবোধের হাতে দেখা গেল একটি খাঁচা, যাতে সূর্যবন্দি। হবেকি বলছে, ‘সুবোধ, তুই পালিয়ে যা এখন সময় পক্ষে না, মানুষ ভালবাসতে ভুলে গেছে।’ এরপর যখন একটি মেয়েশিশুকে প্রশ্ন করতে দেখা গেল, ‘সুবোধ, কবে ভোর হবে?’ তখন মানুষের মন কেঁপে উঠল।
কারণ ভোর না হলে আলো ফুটবে না, আলো না ফুটলে সবুজ জন্মাবে না, অন্ধকারে পথ চলা দায় হবে, মানুষ সত্য-মিথ্যার প্রভেদ বুঝতে পারবে না। তাই সুবোধ হয়ে উঠল সবার বোধের আকাঙক্ষা। সবার আশার প্রতীক। সুবোধ গ্রাফিতির নিয়মিত পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষণকারী এআরকে রীপন বললেন, ‘কোনো অসংগতি দেখা দিলেই মানুষ আগ্রহ করতে থাকে সুবোধের দেখা মিলবে, আগারগাঁওয়ে নয়তো মহাখালীতে অথবা অন্য কোথাও। আসলে কিন্তু সুবোধ আনপ্রেডিক্টেবল, ঝামেলা হলেই তার দেখা মিলবে, তার নমুনা পাওয়া যায় না। কিন্তু আকাঙক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠায় সবাই চায় সুবোধ এখন আমাদের পক্ষে কিছু বলুক। শেষে যা হলো, সুবোধ-ভক্তরা নিজেদের মতো করেই সুবোধ আঁকতে শুরু করল। মেসেজ দিতে শুরু করল নিজেদের প্রয়োজনমতো, সময়ের দাবি অনুযায়ী।’
সুবোধ বাংলাদেশের একমাত্র ফ্যান-মেইড ক্যারেক্টার যাকে ভক্তরা বারবার আঁকতে ভালোবাসে। হুবহু হবেকির মতো আাঁকে, আবার নিজের মতোও আাঁকে। কারণ সুবোধ আছে সবার মধ্যেই, তবে প্রকাশের সুযোগ সবসময় হয় না। এআরকে রীপন শিল্প পরিচর্যাকারী প্রতিষ্ঠান আর্টকনেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আরও বলছিলেন, ‘সুবোধ এমন একটা গল্প যার শুরু নেই, ক্লাইম্যাক্স নেই, হ্যাপি এন্ডিং নেই। বরং এটি সিরিজ গল্প যার পর্বগুলো পূর্ণ নয়। এ গল্পে সবাই অংশ নিতে পারে। নিজের মতো ফাঁক পূরণ করতে পারে।’
অতৃপ্তি সুবোধ চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন রীপন। তার শিল্পীও জানে ভোর হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। তাই এটা নেভারএন্ডিং একটি প্রক্রিয়া। ধাঁধা, বিতর্ক, আবছায়া, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তায় পূর্ণ সুবোধ। কে এই হবেকি? একজন না একটি দল?—এই বিতর্কেই অনেকের অনেক সময় পার হয়। এটিও বড় প্রশ্ন—যখন সে দেয়াল পূর্ণ করে, তখন কেউ তাকে দেখতে পায় না কেন?
রীপন ধারাবাহিকভাবে সুবোধের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা মনে করিয়ে দিলেন:
১. প্রচলিত বোঝাপড়া ও উপলব্ধিকে উল্টে দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
২. নিজের পরিচয় নিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড কিন্তু শক্তিশালী বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে বিতর্ক তৈরি করে।
৩. ভাবনা ও ব্যক্তিত্বের অনিশ্চয়তা দিয়ে শৃঙ্খলা অথবা নীরবতা ভঙ্গ করে।
৪. দ্বন্দ্বমূলক উপকরণ প্রকাশ্যে এনে অসংগতি চিহ্নিত করে।
৫. ‘যেমন চলছে চলুক’ ধরনের প্রবণতাকে সে ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়ে মানুষকে চিন্তিত করে।
রীপন আরও যোগ করলেন, সুবোধের শিল্পী একজন কবি এবং চলচ্চিত্রানুরাগী বলেই মনে হয়। তিনি যখন লেখেন ‘এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি’, আমাদের মধ্যে নজরুলের ‘চল চল’ কবিতার মতো দামামা বেজে ওঠে। তার গ্রাফিতিগুলো পরপর সাজিয়ে নিলে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হওয়ার সুযোগ দেখা যায় যদিও তার ধারাবাহিক সিকোয়েন্স নেই, কিন্তু মেসেজটি বুঝতে কষ্ট হয় না।
সুবোধের শেষ গ্রাফিতিটি দেখা গেছে আগস্ট বিজয়ের দিন কয় আগে টিএসসিতে। মুকুট নিজের মাথায় তুলে নিয়ে শাসকের গদিকে আছড়ে ছুড়ে মারছে সুবোধ। তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সুবোধ কি এবার রাজা হয়ে ফিরছে? কিন্তু সুবোধ-ভক্তরা নিশ্চিত হলেন না। কারণ রাজা হয়ে ফিরে আসায় কী আসে-যায় যদি ভোর না হয়। ভোর না আনতে পারলে সুবোধও নির্বোধে পরিণত হবে। আবার প্রমাণ হবে সে কথা: ‘যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ।’
হবেকি কিন্তু এসবের বাইরে। আমরা যারা তার ভক্ত ও ফলোয়ার তারাই তাকে বলছি, ফিরে এসো সুবোধ ভোর হয়ে গেছে, আর পালানোর দরকার নেই।
সুবোধ পালায় কিন্তু হারিয়ে যায় না বরং লুকিয়ে থাকে। সে হারিয়ে গেলে সূর্যের গতি হবে কি? সুবোধকে তাই প্রত্যেকেই ধারণ করার চেষ্টায় আছে। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর দেয়ালে সুবোধ-ভক্তরা অনেক কিছু লিখেছেন। যেমন, ‘সুবোধ ফিরে আয়, দেশটাকে বাঁচাতে হবে’। আরেক দেয়ালে লেখা হয়েছে, ‘সুবোধ জেগে ওঠো সুদিন আসছে’। আবার বলা হচ্ছে, ‘গণতন্ত্রের হাল ধরতে সুবোধ তুই ফিরে আয়’। আরও আছে, ‘সুবোধ তুই আর পালাস না, থেকে যা আজীবন’, বা ‘সুবোধ জেগে ওঠো সুদিন আসছে’।
সুবোধ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একবার লিখেছেন:
‘সুবোধ তুই পালাস না আর
হাত বরং বাড়িয়ে দে
ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখে
দ্বারভাঙাকে কাঁপিয়ে দে।’
সুবোধকে নিয়ে লেখা হচ্ছে কবিতা। আঁকা হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাফিতি। সবাই প্রতীক্ষা করছে সুবোধের। মুশকিল হলো ছয় মাস ধরে সুবোধের দেখা নেই। কেন?
রীপন বললেন, ‘আগেই বলেছি সুবোধ খুবই আনপ্রেডিক্টেবল। যখন তাকে আশা করা হয় তখন বুঝি সে ঘুমায়। যখন প্রতীক্ষা করতে করতে অন্যরা ঘুমিয়ে পড়ে তখন জেগে ওঠে সুবোধ। আবার একটি ধাক্কা দিয়ে যায়। আর এখন সময়টি কঠিনও বটে। নিজে সে মুকুট পরে নিয়েছে কিন্তু শেষে দেখল এটি টিনের। সোনার মুকুট কোথায় যেন চাপা দেওয়া হয়েছে অথবা কেউ নিয়ে পালিয়েছে। টিনের মুকুট পরে কি সুবোধ জাগানো যায়? নতুন করে পালানোর বুঝি সময় এসেছে আবার সুবোধের, আর সেটা হবে দারুণ দুঃখের।’