আমি যেকোনো অর্থে এই সমাজের “প্রিভিলেজড” একজন নারী। সমাজের প্রচলিত সংজ্ঞায় আমি আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত৷ তা সত্ত্বেও আমার জীবন যুদ্ধ কঠিন, অন্য নারীদের মতোই। হ্যাঁ, যুদ্ধের ক্ষেত্র ও কারণ হয়তো ভিন্ন, ভিন্ন; কিন্তু অজস্র যুদ্ধ আর বিরতিহীন লড়াই আমারও আছে।

আমাকে নিজস্ব চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়। আমাকে জীবনযাপনের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়। আমাকে নিজের শর্তে বাঁচার জন্য লড়াই করতে হয়। আমাকে নিজের আদর্শ ও বিশ্বাস এর জন্য লড়াই করতে হয়৷ নিজের বোধ ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে আয়নার বিসদৃশতাকে হারিয়ে দেবার জন্য নিজের সাথে নিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হয়।

এই লড়াইগুলো হয়তো সব মানুষকেই করতে হয় কিন্তু নারী হওয়ার কারণে (এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারী হবার কারণে) এই লড়াইগুলো আমার জন্য কঠিনতর, শেকলগুলো বেশি ভারী, পথে কাঁকড় ও কাঁটার সংখ্যা অযুতগুণ বেশি, নারী হওয়ার কারণে আমাকে ক্ষতবিক্ষত হতে হয় নিযুতগুণ, নারী জন্মের কারণে পৃথিবীর কুৎসিত নগ্ন ছবিটা আমার সামনে আরো বেশি ঘৃনার্হ হয়ে আসে।

এই লড়াইগুলো করতে গিয়ে, নিজের কিছু বাস্তব অনুধাবন থেকে আমার মনে হয়েছে, নারী স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, বিশেষ করে আর্থিক সক্ষমতার কথা; কিন্ত ক্ষমতায়িত নারীও কী স্বাধীন? এই চিন্তা থেকে আমি ছোট্ট একটা গবেষণার কাজ শুরু করি, আর্থিক ও সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত নারীদের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করি। থিওরিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক মিলিয়ে সেমি স্ট্রাকচার্ড প্রশ্নপত্র ধরে ধরে সেই সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করেছি আমি দীর্ঘ সময় ধরে৷ তালিকায় আছেন সহকারী পুলিশ কমিশনার, সহকারী কর কমিশনার, সহকারী সচিব, কূটনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহকারী সার্জন, সিনিয়র নার্স, বেসরকারি ব্যাংক এর উপ-ব্যাবস্থাপক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর পরিচালক, ফার্মাসিস্ট, উন্নয়ন কর্মী, গবেষক, সাংবাদিক, ফ্যাশন ডিজাইনার, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা৷ আমি মোট পঁচিশ জন নারীর সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করেছি, এর মাঝে একজন নারীকেও পাইনি যিনি তার আর্থিক সক্ষমতার দ্বারা ব্যক্তিগত জীবনে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও স্বীয় সিদ্ধান্তে ক্ষমতায়িত হতে পেরেছেন৷ তত্ত্বের ভাষায়, সমাজ নির্ধারিত ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞাকে ভিত্তি ধরে নিয়েই, আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নারীটিও সর্বাঙ্গীণ “স্বাধীন” ও “পারঙ্গম” নন৷

এই খোঁজ করতে গিয়ে সবচেয়ে চমৎকার যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হলো সেই নারীই অপেক্ষাকৃত বেশি শক্ত অবস্থানে আছেন যার থাকার জায়গাটি নিজের। সেটা চাকুরিসূত্রে পাওয়া কোয়ার্টার হতে পারে, নিজ নামে কেনা এপার্টমেন্ট হতে পারে, নিজ নামে দলিলকৃত বাড়ি হতে পারে কিন্তু পায়ের নীচের মাটিটা হতে হবে তার নিজের। বাপ-দাদার কাছে প্রাপ্য সম্ভাব্য উত্তরাধিকার, মায়ের দান করা জমি কিংবা স্বামীর দেয়া উপহার নয়, বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া ঠিকানা নয়। কথা বলতে গিয়ে জেনেছি, বাবার কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাড়িতে থাকতে গেলেও বাপ-ভাই কেমন বাড়িওয়ালার মতো আচরণ করে। কিংবা নারীটি নিজ বেতনের টাকা থেকে বাড়িভাড়া দেন, কিন্তু বাড়ির চুক্তিপত্রটি স্বামীর নামে, অফিস থেকে বন্ধুর বাড়ির অনুষ্ঠানে গেছিলেন, ফিরতে দেরী হওয়ায় স্বামী দরজা খুলেনি, সারারাত ছাদে বসে ছিলেন; এমনও ঘটেছে। নিজের পয়সায় বাড়িভাড়া দেয়া হবে, তবু বাড়িওয়ালা বাপ/ভাই/বর/পুত্র নামক পুরুষ অভিভাবক খুঁজেছে।

তাই নারীর নিজের মাটি বলতে বোঝায় নারীর নিজ যোগ্যতায় অর্জিত ঠিকানা; যেখানে দরজার ওপরে নেমপ্লেটে তার নাম লেখা থাকে এবং ইচ্ছে হলেই, এমনকি ঝগড়ার ছলেও; বাপের বাড়ি বা বরের বাড়ি কিংবা বাড়িওয়ালা; কেউ তাকে কখনো বলতে পারে না, “বেরিয়ে যাও এই ঘর থেকে”!

প্রতি বছর এর নারী দিবসের মতো এবারেও তাই একটাই অভীপ্সা, নারীর নিজের ঠিকানা৷ ঘর ছোট হোক, ক্ষতি নেই। ছাদ নড়বড়ে হোক, আপত্তি নেই৷ কিন্তু ভিত হতে হবে মজবুত আর নিজের। অনেক কাঁটাতার আর অনেক দেয়াল পেরিয়ে যাবার সাহস নিয়ে নারীকে নিজস্ব একটুকরো মাটি পেতেই হবে৷