ঢাকা ০২:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
জাতীয় সরকারের গুঞ্জন ড: মুহাম্মদ ইউনুস ইন্ডিয়ার জায়গামত আঘাত করেছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাজনৈতিক দলের ঐক্য ভারত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরে বাধ্য: ড. ইউনূস মুন্নী সাহা সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে বেতনের বাইরে জমা হয় ১৩৪ কোটি জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে আ. লীগের দৃষ্টিতে দেখা বন্ধ করতে হবে : ভারতকে নাহিদ ইসলাম “ছাত্রদের ভূমিকা ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা” অশান্তির জন্য মহম্মদ ইউনূসকেই দায়ী করলেন শেখ হাসিনা৷ ফেরত চাওয়া হবে শেখ হাসিনাকে, মানতে বাধ্য ভারত: ড. ইউনূস আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার: শ্বেতপত্রে উন্মোচিত সাংবাদিক মুন্নী সাহা গ্রেপ্তার অচিরেই কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণা: উপদেষ্টা আসিফ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত কেন তথ্যযুদ্ধে নেমেছে? ভারতের দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর: আসিফ নজরুল কোটি টাকার বাস ৯০ লাখে বানাবে বিআরটিসি ভয়েস অব আমেরিকার জরিপ: সংখ্যালঘুরা ‘আগের তুলনায় বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে’ বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের খবর ভুয়া ধানমন্ডি লেকে হবে ‘বিদ্রোহী চত্বর’ সারজি এবং হাসনাতের গাড়ি চাপা দেয়া ট্রাক ও ট্রাকের ড্রাইভার আটক

“সমাজের প্রতিকূলতাকে জয় করে নারীদের ফুটবল বিপ্লব”

মোজাফফর হোসেন
  • আপডেট সময় : ০২:০২:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪ ৫৭ বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

এই যে বাংলাদেশের মেয়েরা টানা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলো, ভাববার কোনো কারণ নেই এখানে গোটা বাংলাদেশ খেলেছে। এর পেছনে আমাদের সমষ্টিক কোনো অবদান নেই।

এই মেয়েরা প্রত্যেকে ফুটবল খেলতে এসে নানাভাবে সামাজিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন। এই যে মেয়েদের এত বাহবা দিচ্ছি, জানেন তারা খেলা শেষ করে ঘরে ফিরলে অনেক পরিবারই তাদের পুত্রবধূ করতে চায় না। নানা রকম ফতোয়ার শিকার হতে হয় খেলোয়াড় মেয়েদের। হামলার শিকারও হয়েছেন!

এর উপর আছে অভাব, অনিশ্চয়তা! খেলে তো একশোজন, কিন্তু জাতীয় দলের বাইরে গেলেই ঠিকমতো মাইনে জুটবে না—সংসার চালাবে কে? অনিশ্চয়তা থেকে বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়েও খেলেছেন সাফজয়ী রাজিয়া। সন্তান জন্ম দিয়ে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন তিনি। মনে আছে ২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে সানজিদা ফেসবুকে লিখেছিলেন: ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’

ছেলেদের ক্রিকেট/ফুটবলে প্রতিটা থানা থেকে খেলোয়াড় উঠে আসে। তেমনটি কিন্তু এই মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। গোটা দেশ তো দূরে থাক, নারী ফটুবল দলের অধিকাংশ ফুটবলারই একটি গ্রাম থেকে আসা। গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উঠে এসেছে একদল ফুটবল কিশোরী। ২০২২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের পাঁচ খেলোয়াড়ই ছিল রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের। তার মানে ভাববেন না প্রতিযোগিতা কম বলে অযোগ্যরা উঠে এসেছে! এবার সাফে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন ঋতুপর্ণা চাকমা, অর্থাৎ এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়া সেরা সে। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলকিপার হয়েছে রূপনা চাকমা।

মূলত নারী ফুটবলে বাংলাদেশকে জাতীয়ভাবে রিপ্রেজেন্ট করছে পাহাড়ি মেয়েরা। তাদের হাতে দিয়েই বাংলাদেশের সাফ-শিরোপা অর্জন। মাঠে আদীবাদী, বাঙালি, হিন্দু, মুসলিম মিলে চমৎকার সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে ওরা, হারিয়েছে ভারতের মতো বৃহত্তর রাষ্ট্রের একটি দলকে। একবার ভেবে দেখুন তো, একই সম্প্রীতি যদি মাঠের বাইরে গোটা দেশে বিরাজ করে তাহলে দেশ কোথায় যাবে? হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং বাঙালি-চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা-ত্রিপুরা-খীসা-মারমা-পাংখোয়া-গারো-খুমী-ম্রো-রাখাইন-ম্রং-মনিপুরী-হাজং-কুর্মি-সাঁওতাল-ওরাঁ প্রত্যেক একসঙ্গে একটা বল নিয়ে ছুটছে, পাস দিচ্ছে একে অন্যকে—ধর্ম আলাদা, ভাষা আলাদা কিন্তু জার্সি এক, মিশন এক—গোল হবে না? না-হোক, একসঙ্গে একসুরে সবাই কাঁদতে তো পারবো?

এই ফুটবলের শক্তি মূলত এটাই। কিন্তু এই মেয়েরা ক্রিকেট/ফুটবল খেলছে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের বিপক্ষে না, পাশাপাশি এই সমাজব্যবস্থার বিপক্ষেও। এই সমাজ একদিনে নারীবিদ্বেষী, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিপন্থী। তাই, সব সময় শুধু মাঠের জয়পরাজয় দিয়ে ওদের শক্তিমত্তা আমি বিচার করি না। হারলেও ওরা একটা বড়ো গেইমে জয়ী হয়েই ওখানে গেছে, ওটাই বৃহত্তর গেইম।

দেখবেন, স্পোর্টসে আমাদের বড়ো সাফল্য এসেছে মেয়েদের হাত ধরে। ক্রিকেটে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মেয়েরা ছয় বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতেছে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে তিনটি টুর্নামেন্ট জেতে তারা। অন্যদিকে পুরুষ দলের মহান নায়করা মাঠে মাঠের বাইরে স্টার হয়েছেন, বড়ো ব্যবসায়ী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন কিন্তু কোনো এশিয়া কাপ আনতে পারেননি। বিপরীতে মেয়েরা শুধু সাফ চ্যাম্পিন না, তাদের অর্জন সাফ অতিক্রম করে গেছে। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো গোল করে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন মনিকা চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি হয়েছেন জয়া চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম কোনো সংগঠক হিসেবে ফিফার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।

অথচ এই মেয়েরা ছেলেদের মতো সমর্থন, সহযোগিতা ও সুযোগসুবিধা পান না। শুনলাম গত তিনমাস বেতন বন্ধ। নানা ক্ষোভ থেকে প্রধান কোচ রিজাইন করেছেন। সরকারিভাবে নারী-পুরুষ ভেদে একই কাজের জন্য বেতন-বৈষম্য থাকার কথা নয়। কিন্তু খেলাধুলায় যেহেতু আয় ও স্পন্সরের একটি বিষয় আছে, তাই পার্থক্য থাকতে পারে। তাই বলে, এক লাখের বিপরীতে এক হাজার টাকার মতো অবস্থা হলে তো মুশকিল!! বেস্ট এগারো জনের জন্য কয়েক হাজার মেয়ের জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। খেলা শেষ করে তারা যাতে স্পোর্টস সংশ্লিষ্ট পেশা বেছে নিতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা কিছু করতে না পারলে, অন্তত প্রতিপক্ষ হওয়া যাবে না। মাঠে ভিনদেশি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়লেও ওদের ব্যক্তিজীবনে, মানে মাঠের বাইরের সংগ্রামটা কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধেই।

ভেবে দেখেন, আমাদের সমাজে ছেলেদের আগে মেয়েদের বিয়ের রীতি। কিন্তু খেলোয়াড় মেয়েদের বিয়ে/সংসার নিয়েও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। পুরুষ ক্রিকেটে জাতীয় দলে চান্স পেয়েই ছেলেরা ‘উপযুক্ত’ পাত্রী দুমদাম বিয়ে সেরে নেন। মেয়েরা সেখানে অধিকাংশ আছেন খেলা নিয়েই।। বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী/শশুরের পরিবার আর খেলতে না দেওয়ার শঙ্কা আছে। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজ বা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে তো আর শশুরের পরিবার বলবে না, “বাবা তুমি বাড়ির জামাই হয়ে ড্যাং ড্যাং করে খেলতে গেলে আমরা সমাজে মুখ দেখাবো কেমন করে??”

সময় মতো বিয়ে না করারও আবার সমস্যা। আমাদের সমাজে পুরুষ মানুষ বিয়ে করার সময় পঞ্চাশোর্ধ হলেও ১৬-২৫ বছরের বয়সী মেয়ে খোঁজেন। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বিয়ে করার সময়ও অল্পবয়সী পাত্রী চায়। অথচ এই বয়সী খেলোয়াড় মেয়েদের ক্যারিয়ার তখন তুঙ্গে থাকে। তাই এক্ষেত্রে অনেকে বাধ্য হয়ে বিয়ে না করার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেন।

ক্রিকেটার জাহানারা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাকে যে বিয়ে করবে সে এবং তার পরিবার ক্রিকেটটা কীভাবে নেবে এসব আমাকে চিন্তা করতে হয়। ক্রিকেট নিয়ে বাইরের ছোট্ট কোনো বাধাও আমি মেনে নিতে পারব না।’ / রুমানা বলেন: ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো শ্বশুর-শাশুড়ি বা হাজবেন্ড চায় না তার স্ত্রী বা ছেলের বউ খেলাধুলার সাথে জড়িত থাকুক। ক্রিকেটটা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। এটার সঙ্গে কোনকিছু মেলালে হবে না। এক্ষেত্রে হাজবেন্ড যদি বাধা দেয়, আমি মানতে পারব না।’

একইরকম প্রত্যয় নিয়ে অন্যতম বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সালমা খাতুন বলেন: ‘যদি আমাকে বিয়ে করতে চায়, হয়তো সংসার করবো। কিন্তু যা-ই করি, মাঠ ছাড়তে পারবো না। ক্রিকেট এখন আমার জন্য খেলা নয়, দায়িত্ব।’

অগোছালোভাবে এত কথা বলার কারণ মূলত একটাই: আমাদের দেশের মেয়েদের অর্জন শুধু ট্রফি বা কাপ দিয়ে বিচার করা যাবে না। এটা এক ধরনের প্রতিবাদ, মৌলবাদ-প্রতিষেধক টিকা, সমন্বয়বাদী সমাজের সেইফগার্ড (ক্রিকেটের ভাষায় abdominal guard)। আমি বলি, আমাদের দেশে কখনো কট্টরপন্থী ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েম হবে না, এর কারণ আমাদের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি না, কারণ গার্মেন্টসকর্মী বোনরা। অর্থাৎ কর্মজীবী নারীরা। বুদ্ধিজীবী অধ্যাপকদের চেয়ে কর্মীজীবী পুরুষদেরও এগিয়ে রাখছি। দেশটা যতটুকু পিছিয়েছে সেটা কথিত আমলা, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদদের কারণেই। অতঃপর তাহারাই বিভেদসৃষ্টিকারী, তাহারাই করাপ্ট এবং তাহারাই সকল নষ্টের গোড়া।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

“সমাজের প্রতিকূলতাকে জয় করে নারীদের ফুটবল বিপ্লব”

আপডেট সময় : ০২:০২:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪

এই যে বাংলাদেশের মেয়েরা টানা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলো, ভাববার কোনো কারণ নেই এখানে গোটা বাংলাদেশ খেলেছে। এর পেছনে আমাদের সমষ্টিক কোনো অবদান নেই।

এই মেয়েরা প্রত্যেকে ফুটবল খেলতে এসে নানাভাবে সামাজিক হেনস্থার শিকার হয়েছেন। এই যে মেয়েদের এত বাহবা দিচ্ছি, জানেন তারা খেলা শেষ করে ঘরে ফিরলে অনেক পরিবারই তাদের পুত্রবধূ করতে চায় না। নানা রকম ফতোয়ার শিকার হতে হয় খেলোয়াড় মেয়েদের। হামলার শিকারও হয়েছেন!

এর উপর আছে অভাব, অনিশ্চয়তা! খেলে তো একশোজন, কিন্তু জাতীয় দলের বাইরে গেলেই ঠিকমতো মাইনে জুটবে না—সংসার চালাবে কে? অনিশ্চয়তা থেকে বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়েও খেলেছেন সাফজয়ী রাজিয়া। সন্তান জন্ম দিয়ে রক্তক্ষরণে মারা গেছেন তিনি। মনে আছে ২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে সানজিদা ফেসবুকে লিখেছিলেন: ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’

ছেলেদের ক্রিকেট/ফুটবলে প্রতিটা থানা থেকে খেলোয়াড় উঠে আসে। তেমনটি কিন্তু এই মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। গোটা দেশ তো দূরে থাক, নারী ফটুবল দলের অধিকাংশ ফুটবলারই একটি গ্রাম থেকে আসা। গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উঠে এসেছে একদল ফুটবল কিশোরী। ২০২২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের পাঁচ খেলোয়াড়ই ছিল রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের। তার মানে ভাববেন না প্রতিযোগিতা কম বলে অযোগ্যরা উঠে এসেছে! এবার সাফে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন ঋতুপর্ণা চাকমা, অর্থাৎ এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়া সেরা সে। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলকিপার হয়েছে রূপনা চাকমা।

মূলত নারী ফুটবলে বাংলাদেশকে জাতীয়ভাবে রিপ্রেজেন্ট করছে পাহাড়ি মেয়েরা। তাদের হাতে দিয়েই বাংলাদেশের সাফ-শিরোপা অর্জন। মাঠে আদীবাদী, বাঙালি, হিন্দু, মুসলিম মিলে চমৎকার সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে ওরা, হারিয়েছে ভারতের মতো বৃহত্তর রাষ্ট্রের একটি দলকে। একবার ভেবে দেখুন তো, একই সম্প্রীতি যদি মাঠের বাইরে গোটা দেশে বিরাজ করে তাহলে দেশ কোথায় যাবে? হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং বাঙালি-চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা-ত্রিপুরা-খীসা-মারমা-পাংখোয়া-গারো-খুমী-ম্রো-রাখাইন-ম্রং-মনিপুরী-হাজং-কুর্মি-সাঁওতাল-ওরাঁ প্রত্যেক একসঙ্গে একটা বল নিয়ে ছুটছে, পাস দিচ্ছে একে অন্যকে—ধর্ম আলাদা, ভাষা আলাদা কিন্তু জার্সি এক, মিশন এক—গোল হবে না? না-হোক, একসঙ্গে একসুরে সবাই কাঁদতে তো পারবো?

এই ফুটবলের শক্তি মূলত এটাই। কিন্তু এই মেয়েরা ক্রিকেট/ফুটবল খেলছে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের বিপক্ষে না, পাশাপাশি এই সমাজব্যবস্থার বিপক্ষেও। এই সমাজ একদিনে নারীবিদ্বেষী, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিপন্থী। তাই, সব সময় শুধু মাঠের জয়পরাজয় দিয়ে ওদের শক্তিমত্তা আমি বিচার করি না। হারলেও ওরা একটা বড়ো গেইমে জয়ী হয়েই ওখানে গেছে, ওটাই বৃহত্তর গেইম।

দেখবেন, স্পোর্টসে আমাদের বড়ো সাফল্য এসেছে মেয়েদের হাত ধরে। ক্রিকেটে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মেয়েরা ছয় বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতেছে। মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে তিনটি টুর্নামেন্ট জেতে তারা। অন্যদিকে পুরুষ দলের মহান নায়করা মাঠে মাঠের বাইরে স্টার হয়েছেন, বড়ো ব্যবসায়ী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন কিন্তু কোনো এশিয়া কাপ আনতে পারেননি। বিপরীতে মেয়েরা শুধু সাফ চ্যাম্পিন না, তাদের অর্জন সাফ অতিক্রম করে গেছে। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো গোল করে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন মনিকা চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি হয়েছেন জয়া চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম কোনো সংগঠক হিসেবে ফিফার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।

অথচ এই মেয়েরা ছেলেদের মতো সমর্থন, সহযোগিতা ও সুযোগসুবিধা পান না। শুনলাম গত তিনমাস বেতন বন্ধ। নানা ক্ষোভ থেকে প্রধান কোচ রিজাইন করেছেন। সরকারিভাবে নারী-পুরুষ ভেদে একই কাজের জন্য বেতন-বৈষম্য থাকার কথা নয়। কিন্তু খেলাধুলায় যেহেতু আয় ও স্পন্সরের একটি বিষয় আছে, তাই পার্থক্য থাকতে পারে। তাই বলে, এক লাখের বিপরীতে এক হাজার টাকার মতো অবস্থা হলে তো মুশকিল!! বেস্ট এগারো জনের জন্য কয়েক হাজার মেয়ের জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। খেলা শেষ করে তারা যাতে স্পোর্টস সংশ্লিষ্ট পেশা বেছে নিতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা কিছু করতে না পারলে, অন্তত প্রতিপক্ষ হওয়া যাবে না। মাঠে ভিনদেশি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়লেও ওদের ব্যক্তিজীবনে, মানে মাঠের বাইরের সংগ্রামটা কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধেই।

ভেবে দেখেন, আমাদের সমাজে ছেলেদের আগে মেয়েদের বিয়ের রীতি। কিন্তু খেলোয়াড় মেয়েদের বিয়ে/সংসার নিয়েও দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। পুরুষ ক্রিকেটে জাতীয় দলে চান্স পেয়েই ছেলেরা ‘উপযুক্ত’ পাত্রী দুমদাম বিয়ে সেরে নেন। মেয়েরা সেখানে অধিকাংশ আছেন খেলা নিয়েই।। বিয়ে হয়ে গেলে স্বামী/শশুরের পরিবার আর খেলতে না দেওয়ার শঙ্কা আছে। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজ বা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে তো আর শশুরের পরিবার বলবে না, “বাবা তুমি বাড়ির জামাই হয়ে ড্যাং ড্যাং করে খেলতে গেলে আমরা সমাজে মুখ দেখাবো কেমন করে??”

সময় মতো বিয়ে না করারও আবার সমস্যা। আমাদের সমাজে পুরুষ মানুষ বিয়ে করার সময় পঞ্চাশোর্ধ হলেও ১৬-২৫ বছরের বয়সী মেয়ে খোঁজেন। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বিয়ে করার সময়ও অল্পবয়সী পাত্রী চায়। অথচ এই বয়সী খেলোয়াড় মেয়েদের ক্যারিয়ার তখন তুঙ্গে থাকে। তাই এক্ষেত্রে অনেকে বাধ্য হয়ে বিয়ে না করার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেন।

ক্রিকেটার জাহানারা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাকে যে বিয়ে করবে সে এবং তার পরিবার ক্রিকেটটা কীভাবে নেবে এসব আমাকে চিন্তা করতে হয়। ক্রিকেট নিয়ে বাইরের ছোট্ট কোনো বাধাও আমি মেনে নিতে পারব না।’ / রুমানা বলেন: ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো শ্বশুর-শাশুড়ি বা হাজবেন্ড চায় না তার স্ত্রী বা ছেলের বউ খেলাধুলার সাথে জড়িত থাকুক। ক্রিকেটটা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। এটার সঙ্গে কোনকিছু মেলালে হবে না। এক্ষেত্রে হাজবেন্ড যদি বাধা দেয়, আমি মানতে পারব না।’

একইরকম প্রত্যয় নিয়ে অন্যতম বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সালমা খাতুন বলেন: ‘যদি আমাকে বিয়ে করতে চায়, হয়তো সংসার করবো। কিন্তু যা-ই করি, মাঠ ছাড়তে পারবো না। ক্রিকেট এখন আমার জন্য খেলা নয়, দায়িত্ব।’

অগোছালোভাবে এত কথা বলার কারণ মূলত একটাই: আমাদের দেশের মেয়েদের অর্জন শুধু ট্রফি বা কাপ দিয়ে বিচার করা যাবে না। এটা এক ধরনের প্রতিবাদ, মৌলবাদ-প্রতিষেধক টিকা, সমন্বয়বাদী সমাজের সেইফগার্ড (ক্রিকেটের ভাষায় abdominal guard)। আমি বলি, আমাদের দেশে কখনো কট্টরপন্থী ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েম হবে না, এর কারণ আমাদের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি না, কারণ গার্মেন্টসকর্মী বোনরা। অর্থাৎ কর্মজীবী নারীরা। বুদ্ধিজীবী অধ্যাপকদের চেয়ে কর্মীজীবী পুরুষদেরও এগিয়ে রাখছি। দেশটা যতটুকু পিছিয়েছে সেটা কথিত আমলা, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদদের কারণেই। অতঃপর তাহারাই বিভেদসৃষ্টিকারী, তাহারাই করাপ্ট এবং তাহারাই সকল নষ্টের গোড়া।